ড: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
(লেখক বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ও গবেষক)
ভাগরথী নদী মুর্শিদাবাদ জেলাকে পূর্ব পশ্চিমে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। ভাগীরথীর পূর্ব অংশের স্থানীয় নাম বাগড়ি, আর পশ্চিম অংশের নাম রাঢ়। মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর, জিয়াগঞ্জ, জঙ্গীপুর বাগড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। তেমনই কান্দি, আজিমগঞ্জ, রঘুনাথগঞ্জ রাঢ় অঞ্চলে অবস্থিত। কান্দি মহকুমা মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অংশের একদম দক্ষিণে অবস্থিত। মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অংশের, পাশাপাশি কান্দি মহকুমার একদম দক্ষিণ প্রান্তের একটি গঞ্জ হলো সোনারুন্দি। ১১৮০ খ্রিষ্টাব্দে সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেন বাসুদেব নামক এক মুখুটি বংশীয় ব্রাহ্মণকে বল্লিহিটা নামক একটি গ্রাম দান করেছিলেন। এই দানপত্র উদ্ধারণপুরের কাছে নৈহাটি নামক গ্রামে আবিষ্কৃত হয় বলে এর নাম নৈহাটি তাম্রশাসন। এই বল্লিহিটা ( বর্তমান নাম বালুটিয়া) গ্রাম বর্তমান আজিমগঞ্জ-কাটোয়া রেলপথের গঙ্গাটিকুরী রেল স্টেশনের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। এই তাম্রশাসনে ওই গ্রামের চৌহদ্দি বর্ণনায় সোনারুন্দি এলাকার অনেকখানি পরিচয় আছে। বালুটিয়া গ্রামের দু কিমি পশ্চিমেই বর্তমান সোনারুন্দি গ্রাম। ওই তাম্রশাসনে বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রাচীন নাম আছে। জলসথি (এই নামেই এখনও অবস্থিত), মোলাদণ্ডী (মুরুন্দি নামে পরিচিত, সোনারুন্দি গ্রামের ঠিক পূর্বে, ঈষৎ দক্ষিণে), খাণ্ডয়িল্লা (খাঁড়ুলে, সোনারুন্দি গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বে প্রাচীন সিঙ্গাটিয়া নদীর দক্ষিণে) ইত্যাদি গ্রামের নাম পাওয়া যায়। এখান থেকে বোঝা যায় লক্ষণ সেনের সময় মোলাদণ্ডী বা মুরুন্দি গ্রাম ছিল। ভাষাগত সাযুজ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এই গ্রামের সংলগ্ন লোহারুন্দি ও সোনারুন্দি গ্রামের সেই সময়ের নাম ছিল লৌহদণ্ডী ও স্বর্ণদণ্ডী। প্রাচীন বঙ্গদেশে ‘দণ্ডী’ ছিল বণিক ও কায়স্থদের উপাধী। দণ্ডী থেকেই ওজনের দাঁড়িপাল্লা শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। ফলে বোঝা যায় ‘দণ্ডী’ উপাধীর বণিকেরা এই এলাকায় বসবাস করত ও একেকটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিল। তামা, লোহা ও সোনার ব্যবসাদার ছিল বলেই নিজ উপাধী অনুসারে এই তিনটি গ্রামের প্রতিষ্ঠা করেছিল। এখনও বণিকদের এমনই পরিচয় শোনা যায়, যেমন তাম্রবণিক, কংস বণিক (কাঁসার ব্যবসা), স্বর্ণ বণিক, শঙ্খবণিক ইত্যাদি। বণিকেরা এই রাঢ় অঞ্চলের খুব প্রাচীন বাসিন্দা। ফলে অন্যদুটি গ্রামের সঙ্গে সোনারুন্দি গ্রামটিও প্রাচীন বলেই মনে হয়।
অন্যদিকে সোনারুন্দি সহ এই এলাকায় এখনও তন্তুবায় বা তাঁতীদের বাস বেশি। এখনও এই বহুজাতিক সংস্থার আগ্রাসী বাণিজ্যের দিনে এর আশেপাশে সোনারুন্দি, শিমুলিয়া, এড়েরা, কন্দনাগ, মুরুন্দি প্রভৃতি গ্রামে তাঁতকল আছে। এখনও তাঁতবস্ত্র তৈরি করে অনেকে জীবন ধারণ করে। সুতো তৈরির জন্যে ব্যবহৃত মূল উপাদান রেশম ও কাপাস এই এলাকায় উৎপাদিত হত অতি প্রাচীন কাল থেকেই। কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের সময়ে গঙ্গাপথে যে সমৃদ্ধ ব্যবসা হত, তার মধ্যে রেশম ও কাপাসজাত কাপড় ছিল প্রধান। এই এলাকার তাঁতিদের বোনা কাপড় আরব দেশে যেমন যেত, তেমনই শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা পর্যন্ত রপ্তানি হত। এরও আগে আমরা জানি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গৌড়ের কাপড়ের প্রশংসা আছে। ফলে আমরা বুঝতে পারি ভাগীরথী তীরবর্তী বা রাঢ় এলাকার তাঁতবস্ত্রজাত কাপড়ের সুনাম খুব প্রাচীন। এর থেকে বোঝা যায় সোনারুন্দি এলাকাতেও তাঁতিদের অবস্থান দুহাজার বছরের ঐতিহ্য দাবি করতে পারে।
বঙ্গদেশের তাঁতিদের বিভিন্ন উপাধী এখন চলিত আছে। যেমন – তাঁতি, দালাল, গুঁই, মণ্ডল, দত্ত, দাস, দেব, কুণ্ডু, নন্দী প্রভৃতি। অষ্টাদশ শতকে সোনারুন্দি গ্রামের আশি শতাংশ লোক ছিল তাঁতি সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের পেশাও ছিল রেশম ও কাপাস তুলো থেকে সুতো তৈরি করে কাপড় বোনা। চৈতন্যোত্তর যুগে এই গ্রামের তাঁতিরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। বিশেষত নিত্যানন্দ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল এরা। এই গ্রামের পুর্বে গঙ্গাতীরে উদ্ধারণপুরে নিত্যানন্দের শিষ্য উদ্ধারণচন্দ্র দত্তের শ্রীপাট ছিল। সোনারুন্দির উত্তর-পূর্বে ঝামটপুরে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের রচয়িতা কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীপাট। আবার পাশের গ্রাম দক্ষিণখণ্ডতে শ্রীনিবাস আচার্যের নাতি যাদবেন্দ্র আচার্যের শ্রীপাট ছিল। ফলে এলাকাটি মূলত বৈষ্ণব অধ্যুষিত ছিল। সোনারুন্দির তাঁতিরা উদ্ধারণচন্দ্র দত্তের শিষ্য-প্রশিষ্যদের অনুসারী ছিল। এই গ্রামের দালাল বংশের সন্তান নিত্যানন্দ। সম্ভবত জ্ঞাতিসূত্রে কাসিমবাজারের রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। সেই সুবাদে তিনি অল্প বয়সেই খুব ভালোভাবে ফারসি ভাষা শিখেছিলেন। অল্প বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে বৃন্দাবনে চলে যান। সেখান থেকে তিনি দিল্লির বাদশাহের দরবারে চাকরি জোগাড় করেন। অসাধারণ মেধা ও ফারসি ভাষায় দক্ষতার জন্যে সেই সময়ের মুঘল বাদশা শাহ আলমের (২) সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা হয়।
দিল্লির রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে এবং মারাঠা আক্রমণে এক সময় বাদশা শাহ আলম দিল্লি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি এসে আশ্রয় নেন বর্ধমান রাজের এলাকা কাটোয়াতে। সেই সময়ে নিত্যানন্দ শাহ আলমের সুপারিশে এই সোনারুন্দি এলাকার জমিদারী লাভ করেন। কারো কারো মতে তিনি মনসবদার হয়েছিলেন। বাদশা শাহ আলম তাকে মুঘল পরিবারের রীতি অনুসারে মহারাজ উপাধি দান করেন। এই সময়ে নিত্যানন্দ দালালের উপাধীসহ নাম হয় — আজমদ্দৌল্লা আমিরুল মুলুক জগদীন্দ্র দানিশবন্দ নিত্যানন্দ দেব বাহাদুর।
আজম কথার অর্থ – মহান, বড়, শ্রেষ্ঠ। দৌলার অর্থ – রাজত্ব।
আমিরুল মানে নেতা, অভিভাবক, রাজা, সম্রাট। আমিরুল উপাধি প্রথম ব্যবহার করে দ্বিতীয় খালিফা উমর বিন খাত্তাব। পরে বাগদাদের সকল রাজাই এই উপাধি ব্যবহার করত।
দানিশ বন্দ ও হগমত এ দুটি ফারসি শব্দ। এই দুটি শব্দের অর্থ হলো দয়ালু দানশীল।
ফলে বোঝা যায় নিত্যানন্দকে শাহ আলম কতটা আন্তরিক ও মহান হিসেবে ভেবেছিলেন। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাহ আলম কাটোয়াতে ছিলেন। সেই সময় পর্যন্ত নিত্যানন্দের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব অটুট ছিল। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই শাহ আলম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়ানি সত্ত্ব দান করেছিলেন। সেই সময়ে এই সোনারুন্দি এলাকারও রাজা বা পত্তনিদার ছিল বর্ধমানের রাজারা। সম্ভবত শাহ আলম বর্ধমানের রাজার সঙ্গে যোগাযোগ করেই নিত্যানন্দকে এই জমিদারি পাইয়ে দিয়েছিলেন।
নিত্যানন্দ দেব বাহাদুর সোনারুন্দি গ্রামের পূর্ব প্রান্তে প্রায় চুয়ান্ন বিঘা জমির ওপর তার রাজবাড়ি ও মন্দির নির্মাণ করেন (১৮০৮ খ্রি)। এলাকাটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে চারদিকে চারটি বিশাল তোরণ নির্মান করলেন। মুল রাজবাড়ির সংলগ্ন পশ্চিম অংশে কিশোরী বনয়ারিলালের মন্দির নির্মাণ করলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন রাধাকৃষ্ণ ও অষ্টসখীর মূর্তি। বৃন্দাবনের অনুসরণে তিনি এই সখীসহ যুগল মূর্তির নাম দেন কিশোরী বনয়ারিলালজি। তার চারদিকে দালান, মাঝে নাট মন্দির। লাল বেলে পাথর দিয়ে মন্দিরের সামনের দেওয়াল সাজিয়ে তুললেন। মুল প্রাসাদে একশোর বেশি ঘর ছিল। বায়ুকোণে দাসদাসীদের থাকার জন্যে বাড়ি নির্মাণ করলেন। মন্দিরের পাশেই কিশোরী-সায়র পুকুর কেটে তার ঘাটে স্নানঘর ও পাশেই গোপেশ্বর শিব মন্দির নির্মাণ করলেন। নজর-বাগানে সুদৃশ্য ফুলের ও সুস্বাদু ফলের বাগান করলেন। রাজবাড়ির বাইরে বারোটি কুঞ্জ নির্মাণ করলেন। যেখানে রাস বা ঝুলনের সময় কিশোরী বনয়ারীলালজি যেতে পারেন। মুল অনুষ্ঠানগুলিতে এই দেবমূর্তিগুলিকে নিয়ে যাওয়া হত এই জায়গাগুলিতে। মূল রাজবাড়ির এলাকার বাইরে সোনারুন্দির পূর্ব প্রান্তে ছড়িয়ে ছিল এই কুঞ্জগুলি। প্রত্যেক কুঞ্জে একটি মন্দির, সংলগ্ন পুকুরে বাঁধাঘাট নির্মাণ করেছিলেন তিনি। মূলত তিনি এই বঙ্গদেশে দ্বিতীয় বৃন্দাবন নির্মাণ করেছিলেন। সুসজ্জিত, সুরম্য এই চত্বরকে সকলে বনয়ারীবাদ বলত। আরও দেবতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ও সংলগ্ন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তিনি। কিছু দূরে গঙ্গাতীরে উদ্ধারণপুরে উদ্ধারণচন্দ্র দত্ত, নিত্যানন্দ, শ্রীচৈতন্য ও অন্যান্য বৈষ্ণব মহাজনের পদধুলি-স্পর্শিত জায়গাতে তিনি বিশাল মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সোনারুন্দি থেকে উদ্ধারণপুর পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। পাশে পুকুর কাটিয়ে দিয়েছিলেন সাধারণের ব্যবহারের জন্যে। সেই সময়ে সোনারুন্দি, মুরুন্দি, খাঁড়ুলে, উদ্ধারণপুরে তার জমি ছিল প্রায় চার হাজার বিঘা। আর রাজশাহী, দিনাজপুর (বর্তমান বাংলাদেশ) ও বীরভূমের ময়ুরেশ্বরের কাছেও তাঁর জমিদারী ছিল। তিনি নিজের জন্মসাল অনুসারে দানিশাব্দ চালু করেছিলেন। তাঁর জমিদারী এলাকায় এই অব্দ ব্যবহৃত হত।
নিত্যানন্দের তিন ছেলে – ১) জগদীন্দ্র বনয়ারি লাল বাহাদুর ২) জগদীন্দ্র বনয়ারি গোবিন্দ দেব বাহাদুর ৩) আজমদৌল্লা বনয়ারি কিশোর বাহাদুর। এরা প্রত্যেকেই মুঘল বাদশার দেওয়া উপয়াধি ব্যবহার করত।
বড় ছেলে লাল বাহাদুর ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের বেশ কয়েক বছর আগে মেজো ভাইকে সম্পত্তির সত্ত্ব আরোপ করে বৃন্দাবনবাসী হয়েছিলেন। ছোট ভাই কিশোর ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের আগেই দেহত্যাগ করেন। তাঁর অবিরা স্ত্রী জীবিত ছিলেন। তিনিও মৃত্যুর আগে মেজো দাদা গোবিন্দকে তার সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। ফলে তাদের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয় মেজো রাজকুমার গোবিন্দ দেব বাহাদুর।
এরা তিন ভাই নিঃসন্তান ছিলেন। ফলে গোবিন্দ দেব স্থানীয় এক আত্মীয় রাজবল্লভকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। দত্তকের পরে তার নাম হয় আনন্দ দেব। এদের কুল উপাধি ছিল নন্দী। কিন্তু আনন্দ মদ্যপান, নারী আসক্তি প্রভৃতি কারণে অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যায়। ইনিই রাজবাড়ির পূর্বে বাইজিবাগান প্রতিষ্ঠা করেন। আনন্দের ছেলে মুকুন্দ দাস নন্দীকে মেজো রাজপুত্র গোবিন্দ তার মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকার সেবায়েত নিযুক্ত করে সমস্ত সম্পত্তি দেবত্র করে দেন।
এই মুকুন্দের চার ছেলে বীরেন্দ্র, সুনন্দ, রবীন্দ্র ও পছন্দ।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের পরে বড় রাজকুমার এই রাজবাড়ির অভিভাবক হিসেবে সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন। তিনি সখের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ছিলেন। বাইজি বাগানের ওখানে রাস্তার ধারে বিনা পয়সায় সকাল থেকে চিকিৎসা করেন রোগীদের। সন্ধেতে সেখানেই বসতেন ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে। নিত্যানন্দের সময় থেকেই এখানে দোল উৎসব হত অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে। কেষ্টযাত্রা, রামযাত্রা, পুতুলনাচ আসত। মেলা বসৎ। নাগরদোলা, বায়োস্কোপ আসৎ। তবে মূল আকর্ষণ হলো ঝুমুর। পশ্চিমদেশ থেকে মানে বিহারের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসত ঝুমুরের দল। বাঁধা দল ছিল। এই বছর ঝুমুর দলের দেখাশোনার দায়িত্ব নেয় মেজো রাজকুমার। সে আবার গান বাজনা খুব পছন্দ করে। বেশ সৌখিন। বাইজি বাগানের পাশে গোল পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বসলো এবারের ঝুমুরের দল। দলে প্রত্যেক বছর তিন-চারটি ‘বাই’ থাকে। একেক বছর একেক ‘বাই’ আছে। এরাই রাতে নেচে গেয়ে আসর মাতিয়ে রাখে। অধিকাংশ গানই আদি রসাত্মক। কিছু রাধাকৃষ্ণ, রামসীতার গানও হয়। রাত যত বাড়ে খেউড়ের পরিমাণ তত বাড়ে। এর আড়ালে দলনেত্রী মদের ব্যবসাও করে। আবার বাইজিরা দেহ ব্যবসাও করে। অস্থায়ী দেহ-ব্যবসায় উঠতি রঙিন যুবকেরা বেশ কয়েক দিন মেতে উঠতো।
সেই বছর একটি নতুন ‘বাই’ এসেছিল। তার গানের গলা মিঠে। শান্ত স্বভাব। শোনা গেল সে নাকি নতুন এই দলে। তাই দেহব্যবসায় এখনো সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে নি। সুন্দরী, টানাটানা চোখ। নাচের সময়েও লজ্জাজড়িত ভঙ্গিতে গায়ের কাপড়-চোপর সামলে নিতে দেরি করে না। রঙিন যুবকেরা পেলা ছুঁড়লে কেমন যে করুণ হাসি দিয়ে সেই টাকা কুড়িয়ে নেয়। টানাটানা চোখে যেন সততই সামান্য অশ্রু লেগে আছে। এলাকার যুবকেরা তার দিকে নজর দিল। দিনে অনেকে ঘোরা ফেরা করতে লাগলো। এলাকায় তরুণদের মধ্যে কানাঘুষো শোনা গেল– এ নাকি ‘ঘরুটে’ মেয়ে। বিয়ের রাতেই নাকি এর স্বামী মরে যায়। অভাবের তাড়নায় এসেছে এই ‘লাইনে’।
জনশ্রুতি এই যে — সেই বছরের ঝুমুর গানের চতুর্থ দিনের সন্ধ্যায় মেজো রাজকুমার সেই ‘বাই’কে গিয়ে একটি সোনার গিনি উপহার দিল। গিনি উপহার পেয়ে গলায় আঁচল দিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করল সে। সাবধানে করলো যেন রাজকুমারের পায়ে স্পর্শ না লেগে যায়। মাথা তুলে যখন সে বসলো তখন তার গাল বেয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়লো চোখের জল। রাজকুমার কি বুঝলো কে জানে। সকলেই নিজের মত করে বোঝে’ এটাই জগতের রীতি। ধরা যাক এই বাইজির নাম বৈজয়ন্তী। সংক্ষেপে বৈজু। যে রাতে এই দলের শেষপালা, সেদিন বৈজু নাচ গান কিছুই করতে পারলো না। মাসি ধমক-ধামক দিয়েও আসরে নামাতে পারে নি তাকে। মাঝরাতে যখন দল সবকিছু বাঁধতে শুরু করেছে তখন মেজো রাজকুমার এসে হাজির। এসে একটা মোড়া নিয়ে বসে ডাকলো মাসিকে। মাসি গলায় কাপড় দিয়ে পায়ের তলায় বসলো।
কুমার বলল – মাসি বৈজু আর তোমার দলে যাবে না। ও এখানেই থাকবে। রাজকুমারের আদেশ। মাসি একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতিবাদ করল না। শুধু বলল – বৈজু কি বলে ? বৈজু দূরে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। কোনো কথার সে কোনো উত্তর দেয় না। মাসির ধমক, রাজকুমারের অনুরোধ কিছুতেই সে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বলে না। শুধু মুখে কমদামী কাপড় চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর অঝোরে চোখ থেকে নদীর ধারা বেয়ে গাল, থুতনি, বুকের কাপড়, কোমর বেয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। রাত অনেক হলো। দূরে কোন অজানা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। কোনো কোকিল এক নাগারে ডেকে চলেছে। মাসি প্রচণ্ড জোরে ধমক দিল তাকে। সে বলল – মাসি তুমি তো জানো আমার সাত কুলে কেউ নাই। বাপ তো নতুন বোষ্টিমী নিয়ে দেশত্যাগী। তেনার মুখ তো শুধু একবার দেখলাম ছাদনা তলায়। পরে দেখলাম তার মরা মুখ। কার কাছে আর যাব বলো। হুজুর যদি এখানে রাখে তাহলে এখানেই থাকবো। এই বলে হন হন করে সে চলে গেল গোলপুকুরে বাঁধা ঘাটে। যাবার সময় বলে গেল – মাসি আমার জন্যে কিছুই রেখে যেও না। শুধু এই পরনের কাপড়টুকুই সম্বল থাক আমার। সারারাত সে গোলপুকুরের ঘাটে বসে রইলো। কখন কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর আধখাওয়া চাঁদ উঠে ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশের কোলে।
বৈজুর ঠাঁই হলো নজর বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের ছোট একটি বাড়িতে। তার বাবা ছিল নিত্যানন্দ সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব। সে অসাধারণ বৈষ্ণব পদ গাইতো। কিছু বাউল গানও জানত। বৈজু তার বাবার কাছে খুব ছোট থেকে গানের তালিম নিয়েছিল। গলাও ছিল অসাধারণ। এই বাড়িতে ঠাঁই হবার পরে মেজো, সেজো ও ছোট রাজকুমার প্রায় সন্ধেতে ওখানে গিয়ে ভক্তির গান শুনতো। মূল মন্দিরে সে আসতে পারতো না। তাই ওখান থেকেই সে দুবেলা কিশোরী বনয়ারি লালকে প্রণাম জানাতো। এর ঠিক এক বছরের মধ্যে বৈজু একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলো। কেউ বললো মায়ের মত, কেউ বললো — –।। থাক সে কথা। দেবশিশুটির বয়স যখন প্রায় দু মাস। তখন আবার দোল উৎসব এলো। ঝুমুরের দল এলো। তবে অন্য দল। মেলা বসলো রাজবাড়ির পাশের বাইজি বাগানের মাঠে। দুমাসের দেবশিশুটিকে একজন দাসী এসে নিয়ে গেল বেড়াতে মেলা দেখতে। দাসীর হাত থেকে সেই শিশু কারা যেন নিয়ে গেল। দাসী এসে খরব দিল বৈজুকে। তারা আশেপাশে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে পৌঁছুলো বাইজি বাগানের রান্নাশালায়। সেখানে গিয়ে দেখল – কে যেন সেই দেবশিশুকে উনুনের গরম জলে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে। শিশুটির পুরো শরীর যেন জলে সেদ্ধ হয়ে গিয়েছে। বৈজু জ্ঞান হারালো। এরপর কিছুদিন নাকি বৈজু এখানকার কুঞ্জে কুঞ্জে কেঁদে বেড়াতো আর চিৎকার করে ডাকতো শিশুপুত্রের নাম ধরে। জনশ্রুতি যে এই হত্যাকাণ্ডে রাজকুমার ও তার হিতাকাঙ্ক্ষীদের হাত ছিল। বৈজু কোথায় হারিয়ে গেছিল তারপর। এর কিছুদিনের মধ্যেই মেজো ও সেজো রাজকুমার গুটি বসন্তে একই সময়ে মারা যায়। বড়রাজ কুমার মাঝে মাঝে বলতো – কে মারলি তাকে ?? সেইই তো আমাদের বংশের কুলপ্রদীপ। শাস্ত্রে তো উপপত্নীর গর্ভের সন্তান স্বীকৃত। বড় ও ছোট রাজকুমারও কয়েক বছর পরে মারা যান। চার রাজপুত্রই ছিল অপুত্রক। বড় ও সেজো রাজকুমারের কন্যা ছিল। পুত্র ছিল না। ফলে নিত্যানন্দের ছেলে গোবিন্দ দেবের উইল অনুসারে এই বংশের পুত্ররা এই সম্পত্তি দেখেশোনা করে দেবসেবা নির্বাহ করবে। উইলে আরও উল্লেখ ছিল যে যদি বংশে পুত্র না জন্মায় তাহলে কুলগুরু এই সম্পত্তি দেখাশোনা করে দেবসেবা করবে। না হলে গ্রামের মুখ্য পাঁচ জন ব্যক্তি, অভাবে পঞ্চ গ্রামীণ মুখ্য ব্যক্তিরা এই সম্পত্তি দেখাশোনা করে দেবসেবা নির্বাহ করবে। সেই বাইজির অনিন্দ্যসুন্দর পুত্রকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলার কারণ ছিল সেই উইল। সেই অনুসারে এইপুত্র সম্পত্তির দেখাশোনা করবে। অন্য কেউই আর উত্তরাধিকারী হবে না। এতে অনেকের স্বার্থে আঘাত লাগার ভয় সৃষ্টি হয়েছিল। তার ওপর সে ছিল বাইজির পুত্র।
তবে এখন সেই সম্পত্তির জবর দখল হচ্ছে। অসাধারণ সম্ভাবনা পূর্ণ একটি পর্যটন কেন্দ্রকে কেউ কেউ ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করে অন্যান্য নিদর্শনগুলি ধ্বংস করছে। রাজ বাড়ি ভেঙে পড়েছে, কুঞ্জ গুলি ধ্বংস, মন্দিরের অবস্থা তথৈবচ। নজর বাগান এখন সাধারণের মলত্যাগের জায়গা। চারটি অসাধারণ তোরণের দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস। বাকি দুটিও প্রায় শেষ। সরকার যদি এই দিকে কিঞ্চিত নজর দেয় তাহলে কান্দি মহকুমার মধ্যে বা রাঢ় অঞ্চলে এটি একটি অসাধারণ পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584