সৌমনা সেনগুপ্ত
“তোর মাথার ঠিক আছে তো বাবু, এই অপরিষ্কার শরীরে আমি তোর বউকে ঠাকুর ঘরে ঢুকতে দেবো? ছি ছি এই নোংরা শরীর নিয়ে আমার ঠাকুরের কাজ করবে ও? না না, কিছুতেই না। আমার প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ আছে ঘরে। এই অনাসৃষ্টির কাণ্ড আমি হতে দেবো না। আর তুইও কেমন ব্যাটা ছেলে রে, বউ এর এইসব মেয়েলী কথা আমাকে বলতে এসেছিস? তোর লজ্জা করল না একবারও? আমার তো ঘেণ্না করছে শুনেই। যা এখন ঘরে, পুজোর মেলা কাজ পড়ে আছে যা তো।”
সেদিন ঠাকুর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শাশুড়িমায়ের কথাগুলো খুব আঘাত এনেছিল ভারতী দেবীর মনে। প্রতি মাসে হওয়া মাসিক হলে যে একটি মেয়ে অপবিত্র হয়ে পড়ে, নোংরা হয়ে যায় তা সত্যি জানা ছিল না তার। আর পাঁচটা প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই এটাকেও দেখে এসেছে সে।
কিন্তু শাশুড়ি মায়ের কথাগুলো তার মানা অমানাকে এক ঝটকায় উড়িয়ে দিল। প্রতিবার সরস্বতী পুজোর কাজগুলো বড় নিষ্ঠা ও ভক্তির সঙ্গে করে আসে ভারতী। এমনকি কালও পুজোর সব বাজার, ঠাকুর আনা সবই করেছিল খুশি মনে। আর সকালে উঠেই একদম হঠাৎ করেই তার শরীর খারাপ শুরু হয়ে গেছে।
ভেবেছিল পুজোর কাজ তো কিছু করতে পারবে না শুধু পুজোর সময়টুকু একটু থাকবে কিন্তু সেটিও নিষ্ঠুরভাবে খারিজ করে দেওয়া হয়। অম্বুবাচীর সময় ক্যামাক্ষা মায়ের যোনি নিঃসৃত শোণিত পবিত্র। আর সেই মায়ের অংশ সাধারণ মেয়েদের মাসিক অপবিত্র নোংরা। এই দ্বিচারিতা বুঝে উঠতে পারে না ভারতীদেবী।
পুজোর ফল কাটতে কাটতে এইসবই ভাবছিল সে। কবেকার কথা কিন্তু তার ঘা আজও কষ্ট দেয় ওকে।
আজ আবার এক সরস্বতী পুজো। বাগদেবীর আরাধনায় মেতে উঠেছে আপামর বাঙালি। ভারতী দেবীর বাড়িতেও চলছে পুজোর প্রস্তুতি। আজ সে নিজে শাশুড়ি। মহাশ্বতা ওর বউমা। বড় ভালো মেয়ে। একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায়।
আরও পড়ুনঃ ইতিহাসের অন্ধকার থেকে আলোর পথে ‘শবর’ গোষ্ঠী
কাল ওর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সব বাজার, কেনাকাটি, ঠাকুর কেনা খুব আনন্দের সাথে করেছিল মেয়েটা। কী উচ্ছ্বাস, বাচ্চা মেয়ের মতো এটা নিই ওটা নিই করে যাচ্ছিল শুধু। খুব ভালো লাগছিল ভারতী দেবীর। ওর উচ্ছ্বাস, আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওকে। কিন্তু আজ সকাল থেকেই মনটা খারাপ মহাশ্বেতার। বহুবছর আগে ঠিক যে অবস্থায় ভারতীদেবী ছিল ঠিক সেই একই জায়গায় আজ দাঁড়িয়ে মহাশ্বেতা। কাজগুলো গুছিয়ে মহাশ্বতার ঘরের দিকে যায় ভারতীদেবী।
বিছানায় মুখ কালো করে বসে আছে মেয়েটা, “শ্বেতা নে ওঠ স্নান করেছিস? স্নান না করলে করে নে,স্নান করে এই শাড়িটা পড়ে নীচে আয়, আমি ঠাকুরমশাইকে বলে রেখেছি আজ পুজোর আরতিটা তুই করবি।।বুঝলি? নে তাড়াতাড়ি আয়।”
আরও পড়ুনঃ রবিবারের গল্পঃ চকলেট
কথাগুলো বলে শ্বেতার হাতে শাড়িটা দিয়ে মুচকি হাসে ভারতীদেবী। “কিন্তু মামনি আমার তো শরীর খারাপ হয়েছে, এই অবস্থায় আমি ঠাকুর ঘরে যাব কী করে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শ্বেতা।
“শোন শ্বেতা তোর কী হয়েছে? কিছুই তো নয়। প্রত্যেকমাসে প্রাকৃতিক কারণে এটা হয় এতে অপবিত্রের কিছু তো নেই। পুজো করার জন্য শরীর নয় দরকার হয় একটি পবিত্র মনের। আর তোর মন যে কতটা পবিত্র তা আমি জানি মা। আর আজ যদি তোকে আমি ঠাকুর ঘরে থাকতে না দিই তাহলে সব থেকে বড় অন্যায় আমি করতাম,তাই না? যা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়।”
“মামনি,একটু দাঁড়াও,” শ্বেতা একটা প্রণাম করে ভারতী দেবীকে। চোখে জল নিয়ে শ্বেতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভারতী দেবী। আর মনে মনে বলে- স্ব পেরেছে শাশুড়ি থেকে মা হয়ে উঠতে। পেরেছে পুরনো নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে পরিবর্তন আনতে। হোক না সে নিজের ঘর থেকেই। তবুও বদল তো।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584