ফিল্ম সমালোচনা
“ইত্তেফাক”– ড. মানবেন্দ্রনাথ সাহা
সাসপেন্স থ্রিলারের একটা প্রধান বৈশিষ্টই হলো রহস্যের নানা জাল বুনন এবং তাকে নিপুণভাবে গুটিয়ে আনা। ২০১৭-র ইত্তেফাক ছবিতে পরিচালক অভয় চোপড়া সেই কাজে সফল হয়েছেন। ১৯৬৯-এ যশ চোপড়া একই নামে একটি ছবি করেন। প্রযোজক দাদা বি.আর.চোপড়া। পৌত্র অভয় এই ছবির রিমেক বানিয়ে দুই দাদুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ছেন। মূলের থেকে সরে এসে নয়, তাকে সমকালে সম্প্রসারিত করে রিমেকটি করা হয়েছে।
১৯৬৯-এ যশ চোপড়ার ইত্তেফাক ছবিতে অভিনয় করেন রাজেশ খান্না, নন্দা, ইফতেকার। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ছবিটিকে রিমেক বানাতে গিয়ে চিত্রনাট্যকার অভয় একটা নিটোল রহস্যের বাতাবরণ তৈরি করেছেন আখ্যানে। সুনিপুণভাবে দুটো খুনের ময়না-তদন্ত করা হয়েছে ঘনীভূত রহস্যের রস বজায় রেখে। সাসপেন্সকে কোনোরকম শিথিল হতে না দিয়ে।
ইত্তেফাক ছবির শুরুটা হয় এক নাটকীয় উত্তেজনা ও রহস্যের মধ্য দিয়ে। স্থান মুম্বই শহর। সময় বৃষ্টি ভেজা রাত। গোটা ছবির একটা সিগনেচার টিউন এই পরিবেশ। বাইরে বৃষ্টির শহর আর ভিতরে দমবন্ধ বিলাসবহুল জীবনের বিকৃতি ও হনন। পুরনো ইত্তেফাকের সঙ্গে এর শুরুর মিল আছে। ওখানে নায়ক চিত্রশিল্পী দিলীপ ( রাজেশ খান্না) মানসিক হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছিল এইরকম বৃষ্টির রাতে। এই রকম কাকতালীয় ভাবেই নায়িকা নন্দার ঘরে সে ঢুকে পড়ে।শুরুর মিলটুকু ছাড়া অভয়ের ইত্তেফাকে কাহিনির নতুন ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে।
বিক্রম ( সিদ্ধার্থ মালহোত্রা) একজন ব্রিটিশ জনপ্রিয় লেখক, ভারতীয় বংশদ্ভূত। সেই রাতেই তার দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হবে মুম্বই-এ। বিক্রম হোটেলে ফিরে এসে দেখে তার প্রকাশক স্ত্রী ক্যথরিন (কিমবারলে ম্যাকবে) মৃত। সে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিস আসতেই হঠাৎই সে তার দামি গাড়ি নিয়ে মরিয়া হয়ে পালাতে শুরু করে। পুলিশও তাকে চেজ করে। গাড়ি উল্টে দুর্ঘটনায় পড়ে, বিক্রম আহত রক্তাত হয়ে কাছের একটি অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়ে আশ্রয়ের জন্য। সেই রাতেই মায়া( সোনাক্ষী সিনহা)এক জন হাউস ওয়াইফ যে ঐ অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাতে টহল দেওয়া পুলিশের গাড়ির সামনে আার সাহায্য চায়। পুলিসকে নিয়ে যায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টে যেখানে খুন হয়ে পড়ে আছে তার অ্যাডভোকেট স্বামী শেখর। তার পাশেই নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে বিক্রম।
মুম্বই নগরীতে একই রাতে দু-দুটো খুনের কিনার করার দায়িত্ব এসে পড়ে পুলিস অফিসার দেব (অক্ষয় খান্না) এর উপর। রহস্যঘন দুই খুনের উদ্ঘাটন করতে গিয়ে জটিল আবর্তের মধ্যে পড়ে দেব। চিত্রনাট্যকার এখানে সুন্দরভাবে বিক্রম ও মায়ার আলাদা বয়ানের ভিন্নতায় আখ্যানে জটিলতা ও রহস্য এনেছেন। এখানে দেবের একটা সংলাপ ” ইস কহানি মে তিন পহেলু হ্যায় – এক বিক্রমকা, এক মায়াকা অউর এক সচ। হমে সচ ঢুডনা হ্যায় ”
ক্যামেরার নিপুণ চোখে রহস্য মায়া ছড়ায়। জেল, বৃষ্টিভেজা মুম্বই, ফ্ল্যাটের ভিতরে তদন্ত এক গুমোট আবহ তৈরি করে। বিক্রমকে জেরা, মায়াকে জেরা দেবের নিজস্ব ভাষ্য সব মিলে কয়েকটি প্রশ্ন তোলপাড় করে দর্শকে। হুয়া ক্যায়া কাল রাত কো? প্রশ্ন এক. বিক্রম তার স্ত্রীকে মারলো কেন? প্রশ্ন দুই. মায়ার অ্যাডভোকেট স্বামী শেখরকে মারলোকে? এই সব উত্তর দ্বন্দ্ধমথিত করে পুলিশ অফিসার দেবকে। তিনদিনের ভিতর তাকে উত্তর খুঁজতেই হবে।
নানা বয়ানের ভিতর থেকে তার নিজস্ব বয়ান যোগ করে দোষী শেষপর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়। রহস্যের উত্তাপ ও গ্রাহ্য যুক্তির ভিতরে। সবই ইত্তেফাক বা কো-ইন্সিডেন্ট বা কাকতালীয় নয় কিন্তু! ছবির ঘনীভূত রহস্যের জাল কীভাবে ছাড়ানে হলো সে কেবল ছবি দেখেই জানতে হবে। রহস্যময় থ্রিলারের এটাই শর্ত। হিচকক থেকে একাল পর্যন্ত। তবু ছবির শেষে যে টুইস্ট আছে যা পুরনো ইত্তেফাক থেকে অভয়ের ইত্তেফাককে আলাদা করে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, দিয়েছে মৌলিকতাও। পুরনো ইত্তেফাক সিনেমার শেষে যে নিয়তির তাড়নার কথা আবেগমথিত ভাষ্যে বলা হয়েছে তা এখানে নেই। বরং বিলাসবহুল জীবনে নর-নারী যে ছলাকলা শিখে নিয়েছে সেখানে দেব-র মতো পুলিস অফিসারও আবেগের দ্বারা চালিত হয়ে ভুল করে বসে। সেটাও এক ইত্তেফাক।
অভিনয়ের আলোচনায় প্রথমেই চলে আসবে পুলিস অফিসারের চরিত্রে অক্ষয় খান্নার অনবদ্য পরিমিত অভিনয়। যার প্রতিটি কথার ভিতর রসবোধ আর তীক্ষ্ণতা মিলে মিশে আছে। পুরনো ইত্তেফাকে পুলিস অফিসার চরিত্রে ইফতেকার সেই মনোযোগ পাননি রাজশ খান্নার স্টারডমের কাছে। কিন্তু এখানে এই চরিত্রটায় প্রধান। নায়ক সিদ্ধার্থ লেখকরূপে স্মার্ট কিন্তু নিঃস্প্রভ। ফলে অসাধারণ অভিনয়ে মাতিয়েছেন অক্ষয়। তার নতুন চেহারাটাও চরিত্রের অনুকূল হয়েছে। হিন্দি সিনেমা জগতে অক্ষয় মোস্ট আন্ডাররেটেড অ্যাক্টর। সেটাই তার মূলধন। কোনো ম্যানারিজম ছাড়া কয়েকটি দৃশ্যে তিনি অনবদ্য। ১. জেলে বিক্রমের প্লেট থেকে ইডলি টেনে খেতে শুরু করা। ২. লিফ্টের ভিতর তার বিরক্তি ও সংলাপ। ৩. রাগ প্রকাশে তার সংলাপ : তেরে য্যায়সে ভুট্টে হম রোজ সেঁককে খাতে হ্যায়। ৪. বারবার তার রুমাল দিয়ে বৃষ্টির কাদা মুছে নেওয়া যা পরে রহস্য উদ্ঘাটনে কাজে এসেছে। ৫. ছবির শেষে ব্যর্থতাকে ইত্তেফাক বলে মেনে নেওয়ার অসহায়তা প্রকাশে। রসিক, বুদ্ধিদীপ্ত, কঠিন দায়িত্বপালনে পটু এই চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে বিকল্প কাউকে ভাবা যাবে না।
সিদ্ধার্থ চরিত্র অনুযায়ী। তবু বলবো লেখকের সেই নমনীয় মন তার ভিতর খঁুজে পাওয়া যায়নি। সোনাক্ষী নন্দার ধারে কাছে যেতে পারেননি। চিরাগের সঙ্গে তার যৌন দৃশ্যটিও লঘু। চিত্রনাট্য তাকে সাহায্য করেনি। শেষ দৃশ্যে অক্ষয়ের স্ত্রীর ভূমিকায় মন্দিরা বেদি পরিমিত ও প্রয়োজনীয় অভিনয় করেছেন। তবে আলাদা উল্লেখ থাকবে কয়েকটি ছোট দৃশ্যে কনস্টবেল তাম্বের চরিত্রে অজয় যাদবের অভিনয়। মুম্বই পুলিশের টিপিক্যালিটির ভিতরেও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন পুলিশের ভাষা, রুচি ও যাপিত জীবনের নানা অভিঘাতকে।
পুরনো ইত্তেফাক ছবিটিতে কোনো গানের ব্যবহার ছিলনা। অভয় গান রেকর্ড করা সত্ত্বেও সংগত কারণে ব্যবহার করেননি যা তার পরিমিত শিল্পবোধের পরিচায়ক। সেই জায়গাটা পূরণ করেছে তানিষ্ক বাগচির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের চমৎকার ব্যবহার। রাতের মুম্বইকে জীবন্ত করেছে শুধু নয় ভাষা দিয়েছে মিচেল লুকার অনবদ্য ফটোগ্রাফি।
ছবির প্রোমোতে পরিচালক বলেছেন : one incident two version কিন্তু ছবির শেষে অনেক ভার্সন তৈরি করেছে যা অনিবার্য। দর্শকেরও ভার্সন যুক্ত হবে তার সঙ্গে। থ্রিলার হিসেবে নানা গুণ ছড়িয়ে থাকলো ছবিটিতে। ছবিটি প্রযোজনা করতে সহযোগি হয়েছেন শাহরুখ খান। তার প্রয়াত মার পছন্দের ছবি এটি। পরিবেশনাও করেছে তার রেড চিলিজ। এটাও একটা দৃষ্টান্ত। ভালো ছবির প্রোমোট করার। অল্প বাজেটের এই ছবি বাণিজ্যিকভাবে কতখানি সফল হবে জানিনা তবে ভারতীয় সাসপেন্স থ্রিলারের ধারায় ছবিটি সফল তালিকায় থাকবে বলা যায়। দু-একটি বিচ্যুতি বাদ দিলে ছবিটি অন্য মাত্রা এনেছে এই ধারায়। সেটা অভয়ের প্রতিভার গুণেই। তাকে কাকতালীয় বলা যাবে না!
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584