প্রকৃতির অবদান স্বীকার করে সূর্য আরাধনাই ছট পুজোর মূলমন্ত্র

    0
    778

    প্রকৃতির অবদান স্বীকার করে সূর্য আরাধনাই ছট পুজোর মূলমন্ত্র-সংহিতা দেব

    লেখিকা

    দেওয়ালির ছয় দিন পর এই উৎসব, ছট পুজো।ছট্‌ পূজা সূর্যদেব, মা অন্নপূর্ণা ও গঙ্গাদেবীর পূজা।উৎসবের আগের দিন দুপুর থেকেই আমরা দেখতে পাই অজস্র মানুষ ফল,ফুলের ডালা সাজিয়ে ঢাকবাদ্যি সহ রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন নদী বা সমুদ্রের দিকে। এটি একটি এমন পুজো যাতে পুরোহিত বা মন্দিরস্থল লাগে না।

    লেখক শৈলজানন্দ সামন্তের ‘ছট্‌ পূজা’ শীর্ষক গ্রন্থ সূত্রে জানা যায় যে,
    “ভারতবর্ষের হিন্দীভাষী হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পূজা ছট্‌ পূজা। ছট্‌ অর্থাৎ ছটা বা রশ্মির পূজা। এই রশ্মি সূর্য থেকেই পৃথিবীর বুকে আসে। সুতরাং এই পূজা আসলে সূর্যদেবেরই পূজা।”

    কার্তিক মাসের অমাবস্যার পড়েই ছট্ ব্রত পালন করা হয়। এই পুজো মূলত: চারদিনের উৎসব। চতুর্থী থেকে শুরু হয়ে পঞ্চমী,ষষ্ঠী ও সপ্তমী হয়ে শেষ হয়। নতুন জামা কাপড় আর লোকসংগীতে মেতে উঠে এই উৎসব পালন করা হয়। কোথাও কোথাও বলা হয়েছে সূর্য আর ষষ্ঠী হলেন ভাই ও বোন, সেই কারণেই ছট্ বা ষষ্ঠীদেবীকে “ছোট্টী বা ছট্টী মাইয়া” বলা হয়।এই পূজার সঙ্গে জড়িত আছেন স্বয়ং সূর্যদেব, আছেন মা গঙ্গা এবং দেবী অন্নপূর্ণা। প্রথম দিনটিকে ‘নহায় খায়’ বলা হয়। এইদিন গঙ্গা স্নান করে মহিলারা একবারই খান ভাত ও লাউ সিদ্ধ।দ্বিতীয় দিন টিকে বলা হয়,”খর্না”। এই দিন নির্জলা উপবাস করে সূর্যাস্তের পর সূর্যদেবতাকে অর্পণ করে পায়েস,ক্ষীর, পুরি,ঠেকুয়া, কলা বিতরণ করা হয়।বিবাহিতা মহিলারা একে অপরের সিঁতি তে গেরুয়া সিঁদুর লেপে দেয়। তৃতীয় দিন হল মূল দিন, ছট। এই দিনও নির্জলা উপবাস করে সন্ধ্যাবেলায় ডালাতে ঠেকুয়া,ফল,কলার ছড়া সাজিয়ে অর্পণ করে। এরপর বাড়িয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ৫টি বেতের কাঠি দিয়ে ঢেকে “কোশি” পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ দিন টি সব থেকে পবিত্র দিন।এই দিন দলে দলে ভক্ত চিনি ও আদা মুখে দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন আনন্দের সাথে।

    ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ রয়েছে — বর্ষার ঋতু এসেছে কিন্তু বৃষ্টি তেমন হয়নি। চাষিগণ চিন্তিত ফসল মাঠেই শুকিয়ে যাচ্ছে। মা অন্নপূর্ণা ক্রমশ অবসন্ন হয়ে পড়ছেন,রুক্ষতা প্রাপ্ত হচ্ছেন। সকল দেবতা মা অন্নপূর্ণার অবসাদগ্রস্থ ও দুর্দশা প্রাপ্ত । চতুর্দিকে অন্নাভাবে হাহাকার উঠেছে। সূর্যের তাপ কমানোর জন্য মা অন্নপূর্ণা সূর্যদেবের ধ্যান করতে শুরু করেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়। সূর্যের প্রখর ছটায় মা অন্নপূর্ণা দিন দিন শ্রীহীন হতে থাকেন। দেবলোকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেবতারা সমবেত ভাবে সূর্যদেবের কাছে যান। মা অন্নপূর্ণার এই দশার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন এবং প্রার্থনা করেন, “মা অন্নপূর্ণা যেন মা গঙ্গাদেবীর আশ্রয় নেন। অস্তগমনকালে মা গঙ্গাদেবীর আশ্রয়ে থেকে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতিথিতে এবং সপ্তমীতিথির উদয়কালে মা অন্নপূর্ণা যেন তাঁর সূর্যদেবের উদীয়মান ছটা বা রশ্মিকে দেখে তাঁর বা ১২টি নাম উচ্চারণ করেন; তাহলেই সমস্ত পৃথিবী অন্নে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই নিয়মে যিনি পুজো করবেন সূর্যদেব তার উপরই তিনি প্রসন্ন হবেন।এই ভাবেই মা অন্নপূর্ণা আবার তাঁর শ্রী ফিরে পান।

     

    কোন কোন পৌরাণিক কাহিনীতে (ভবিষ্যপুরাণ) বলা হয়েছে, শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দ বৎসর বনবাসের পর অযোধ্যায় ফিরে এসে সূর্যদেবের আরাধনা করেন।সেদিন থেকেই এই পূজার উদ্ভব।সীতা দেবী মিথিলার জনকপুরের কন্যা। মিথিলাই ছট পুজোর কেন্দ্রস্থল। এখন এই পুজো কলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই,ঝারখন্ড,বিহার ইত্যাদি অঞ্চল ছাড়াও নেপাল,ফিজি, মরিসাস,ওয়েস্ট ইন্ডিজেও প্রচলিত।মূল কথা হল বিহারের বাসিন্দা যেখানে যেখানে আছে এই পুজো সেখানেই প্রচলিত।

    আবার “মহাভারতের বনপর্বে বলা হয়েছে যে, সূর্যপুত্র কর্ণ পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত থেকেই শুধুমাত্র অঙ্গরাজ্যের মঙ্গলের জন্য এইদিন সূর্য-আরাধনা করেছিলেন।সেই দিন থেকেই এই পূজা কেবলমাত্র অঙ্গরাজ্যবাসীগণের এক মূল পূজা রূপে পরিগণিত হল।
    ইতিহাসে প্রাচীন ভারতবর্ষের মানচিত্র, “অঙ্গরাজ্য” হিসেবে ভারতবর্ষের সেই স্থানগুলিকেই চিহ্নিত করেছে যেখানে বর্তমানে “ছট্পূজা” বহুল ভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

    এর বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ বলা যায়, গঙ্গার জলে সেচ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে অনাবৃষ্টিতেও খেত-খামার অন্নে পূর্ণ হয় এবং স্বাভাবিকভাবে মনুষ্যসমাজে খাওয়া-পরার অভাব থাকে না। এই ব্রত পালনে সূর্যদেবের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আমাদের জীবনে যেমন বিঘ্ননাশক, দুঃখনাশক, তেমনি সুখদায়ক ও অর্থ-বৈভবদায়ক।

    ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে আবার বলা হয়েছে,সূর্যপত্নী তথা বিশ্বকর্মা তনয়া “সংজ্ঞা” সূর্যদেবের তাপ সহ্য করতে পারেন নি, বিশ্বকর্মা সূর্যকে মোট ১২টি ভাগে ভাগ করেন। সেই ১২টি অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন মাসে উদিত হয়। বৈশাখ মাসের অংশের নাম– তপন ,
    জ্যৈষ্ঠ মাসের অংশের নাম– ইন্দ্র,আষাঢ় মাসের অংশের নাম- রবি শ্রাবণ মাসের অংশের নাম– গর্ভস্থি,
    ভাদ্র মাসের অংশের নাম– যম,আশ্বিন মাসের অংশের নাম– হিরণ্যরেতা,কার্তিক মাসের অংশের নাম– দিবাকর,অগ্রহায়ণ মাসের অংশের নাম– মিত্র,পৌষ মাসের অংশের নাম– বিষ্ণু,
    মাঘ মাসের অংশের নাম– অরুণ, ফাল্গুন মাসের অংশের নাম– সূর্য, চৈত্র মাসের অংশের নাম– বেদজ্ঞ।

    সূর্যদেবের আত্মারূপী অংশ হিসেবে এই ১২টি ভাগকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এই অর্থের সূর্যের অপর নাম দ্বাদশাত্মা। এই নামগুলো হলো-

    ১) অর্যমা,
    ২) উরুক্রম,
    ৩) ত্বষ্টা,
    ৪) ধাতা,
    ৫) পূষা,
    ৬) বরুণ/জাতবেদা,
    ৭) বিধাতৃ,
    ৮) বিবস্বান্,
    ৯) ভগ,
    ১০) মিত্র,
    ১১) শক্র

    ১২) সবিতৃ

    ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলের ৬২তম সূক্তের ১০ম্ মন্ত্রে বলা রয়েছে “তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচেদয়াৎ।”অর্থাৎ যিনি আমাদের ধীশক্তি প্রেরণ করেন, আমরা সেই সবিতৃদেবের সেই বরণীয় তেজকে অনুধ্যান করি। এই অর্থে সবিতৃদেব ধীশক্তির অধিষ্ঠাতা দেবতা।
    সবকিছুই সূর্যদেব থেকেই সৃষ্টি এই অর্থে সর্বপ্রসবিতা এবং জগৎস্রষ্টা।

    সুস্বাস্থ্য লাভ ছাড়াও সূর্য পুজোর দ্বারা জীবকুলের প্রাণস্বরূপ সূর্যকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাবার সুযোগ পাই।সমস্ত রকম ভাবে সুখী ও সুস্থ থাকার জন্য সূর্য মন্ত্র অন্যতম প্রভাবকারী। শুদ্ধ উচ্চারণে পঠিত ও মানসে অনুরণিত এইটি এমন এক মন্ত্র যার সুপ্রভাব সারা দিন ধরে চলতে থাকে।সুর্যপ্রণাম প্রণালীও সর্বশরীরের উপযোগী এর ব্যায়াম। তাই সূর্যের আরাধনা শরীর, মন, ধন, যৌবন,জীবনকে সর্বতভাবে প্রভাবশালী করে তোলে।
    তাই আসুন সকলেই নিজ নিজ এবং দশদিশের মঙ্গলকামনায় বৈদিক দেবতা “সূর্যদেবকে” প্রণিপাত করে বলি,

    “ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্ ।
    ধান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতঃ অস্মি দিবাকরম্ ।

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here