রিচা দত্ত, মুর্শিদাবাদঃ
চারদিকে যখন ধর্ম নিয়ে হানাহানি তখন সুতী থানার মহেন্দ্রপুর গ্রামে দেখা গেল সম্পূর্ণ অন্য নজির। মহেন্দ্রপুর গ্রামে ৫০০০ পরিবার বাস করে। তারা সবাই মুসলিম।
এখানে একটি পরিবারও হিন্দু না। অথচ ঈদগাহের পাশেই রয়েছে বেদী যেখানে কালীপুজো হয়। প্রতি অমাবস্যা পুজো হলেও দীপাবলিতে যে বিশেষ পুজো হয় তার সমস্ত রকম জোগাড় মুসলিমরাই করে থাকে। পুজো করে হিন্দুরা।
বেদীর সামনে আছে একটি চায়ের দোকান। সেখানে চা খেয়ে বেদীর মধ্যে চায়ের ভাড় যাতে না পড়ে তার জন্য চা দেওয়ার সময় খদ্দের কে আগেই সচেতন করে দেওয়া হয়।
ক্লাবের সব সদস্য মুসলিম। তারা ঈদগাহ যেমন পরিস্কার পরিছন্ন রাখে সেভাবে কালির বেদীর যত্ন নিয়ে থাকে। তাদের বক্তব্য অন্য কোনও ধর্ম কে অসম্মান করে নিজের ধর্ম কে সন্মান করা যায় না। তাই আমরা এই বেদী হিন্দুদের হলেও দেখাশোনা মুসলিমরাই করে। এ বেদী কত বছর থেকে আছে তা সঠিক ভাবে কেউ জানেন না।
এই কালি পুজোয় মুসলিমরাও তাদের বাড়ি আলোকসজ্জায় সাজায়। পোড়ায় বাজিও। এই গ্রামের একটা প্রচলন আছে। প্রতিবার কালীপুজোর রাতে পাটকাঠি জ্বালিয়ে সুর করে বলে, ‘অশুভ যা কিছু আছে তা দূরে যাক। শুভ সব কিছু যেন ফিরে আসে।’ এভাবেই মহেন্দ্রপুরের মুসলিমরা কালীপুজো করে থাকে।
আরও পড়ুনঃ কালীপুজোয় ঠাকুর দেখে বাড়ি ফেরার বাসের দাবি গলসিতে
এই কালীপূজায় তাই গ্রামবাসীরা ব্যস্ত বেদী রং করতে, প্যান্ডেল বাঁধার কাজে। যারা পুজো দিতে আসবে তাদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সে সব নিয়ে ভাবছে এলাকার গ্রামবাসী।
স্থানীয় বাসিন্দা বয়স্ক মহঃ আবু সানাব বলেন, ” বাপ ঠাকুরদার কাছে শুনেছি এই এলাকায় ঘন জঙ্গল ছিল। দিনের বেলা মানুষ একা যেতে ভয় পেত। তখন কিন্তু এই বেদী ছিল স্থানীয় ভাষায় মায়ের থান। অনেকে একে মাঠ কালি বলেও থাকে। সেই সময় থেকে এখানে পুজো হয়।
পরে এখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ বসতি আরম্ভ করে। বেদীকে অক্ষত রেখে চারদিকে ঘর বাড়ি করা হয়। অন্য কোড ও ধর্ম নিয়ে অশান্তি হলেও আজও এখানে তার প্রভাব পড়েনি। আমি চাইব আগামী দিনও এখানে যেন এই আবহাওয়া বজায় থাকে।
তোফাজুল আহমেদ বলেন, ” মহেন্দ্রপুরের কালীপুজো হিন্দুদের হলেও এই দিনটার জন্য মুসলিমরাও অপেক্ষা করে। পূজো করে হিন্দুরা কিন্তু অনান্য কাজ করে এখানকার মানুষ।
ক্লাবের ছেলেরা সেচ্ছাসেবক থাকে। তারাই দেখে কোন সুবিধা-অসুবিধা হলে। এছাড়া কালিপুজোয় বহু মানুষ যারা বাইরে থাকে তারা উৎসবে যোগদান করার জন্য ফিরে আসে। কালিপুজোর আবেগ হিন্দুদের চাইতে এখানকার মানুষের কম কিছু নয়।
রথীন্দ্রনাথ গোস্বামী যিনি থাকেন সুতীর জগতাই গ্রামে, তিনি বলেন, ” শুনেছি মহেন্দ্রপুর গ্রামের মা কালি খুব জাগ্রত। আমার ঠাকুমা সেখানে প্রতি বছর নিষ্ঠার সাথে পুজোর জন্য যেত। তারপর আমার মা। এখন আমার স্ত্রী, বৌমা ও আমি মহেন্দ্রপুর গ্রামে পুজো দিতে যাই।
সেখানে মুসলিম ভাইরা বাস করে। তারাই সমস্ত কিছু আয়োজন করে। আমরা পুজো দিতে গিয়ে যেন কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য সব ব্যবস্থা করে থাকে ওরা। তা ছাড়া বর্তমানে অবিশ্বাসের যুগে যে ভাবে বেদীকে আগলে রেখেছে তা না দেখে বিশ্বাস হবে না। এখানেই পাবেন নজরুলের একই বৃন্তে দুটি কুসুম।”
বিকাশ হালদার থাকেন দফারহাটে, মিলন দাশ অরঙ্গাবাদে, মুন্না বিশ্বাস নিমতিতা কলোনিতে থাকেন। তাদের কথায় মহেন্দ্রপুর গ্রামের মানুষ অত্যন্ত অতিথি পরায়ন।
একদিকে ঈদগাহ ময়দান অন্য দিকে মা কালির বেদী। যেখানে একটিও হিন্দু পরিবার নেই। বেদীর পাশে নিজামউদ্দিনের পরিবার আগলে রাখে বেদীকে। আমরা পুজোর সময় গিয়ে পুজো দিয়ে ফিরে এসে এক বছর আর খোঁজ রাখি না, কারন জানি বেদী মহেন্দ্রপুর গ্রামবসীদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584