নিজস্ব সংবাদদাতা, পূর্ব মেদিনীপুরঃ
দিল্লীর নির্ভয়া কাণ্ডের পর ফের ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা দেশে। হায়দ্রাবাদে এক পশু চিকিৎসককে গণধর্ষণ করে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে দেশ জুড়ে। দোষীদের চরম শাস্তি চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব নেটিজেনরাও। ঘটনার পর দেশে মহিলাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে ফের বড়সড় প্রশ্ন উঠছে।
হায়দ্রাবাদ থেকে অনেক দূরে থাকলেও তরুণী পশু চিকিৎসকের এমন পরিণতিতে নিজ অত্যাচারের ঘটনা মনে পড়ছে কোলাঘাটের নির্যাতিতার পরিবারের। পুলিশ সূত্রের প্রকাশ, গত ২৪ অগস্ট কোলাঘাটে গণধর্ষণের শিকার হয় দশম শ্রেণির এক নাবালিকা ছাত্রী। ওই রাতেই কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে নির্যাতিতা। এরপর ২৮ অগস্ট পুলিশ চার অভিযুক্ত যুবককে গ্রেফতার করে। পরদিন ২৯ অগস্ট কলকাতার এসএসকেএমে নির্যাতিতার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পরে বাকি দু’জন অভিযুক্তকে কোলাঘাট থানার পুলিশ গ্রেফতার করে।
আবার ঠিক এক বছর আগের ঘটনা। গত ২৮ অক্টোবর, ২০১৮ তে পাঁশকুড়ার মধুসূদন বাড়ের মেধাবী ছাত্রীকে চলন্ত সাইকেল থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সমীর সাহু নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে। সাইকেলের ব্রেক ছাত্রীর নিম্নাঙ্গে ঢুকে যাওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায় সে। এরপর ২৯ অক্টোবর অভিযুক্ত সমীরকে গ্রেফতার করে পাঁশকুড়া থানার পুলিশ।
এখন অবশ্য কীর্তিমান অভিযুক্ত যুবক জামিনে মুক্ত।
হায়দ্রাবাদে তরুণী পশু চিকিৎসককে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় গোটা দেশের পাশাপাশি আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে জেলার মহিলাদের মনেও। শুধুমাত্র গণধর্ষণের শিকার নন মহিলারা।
জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় নিত্যনৈমিত্তিক যৌন নির্যাতন, যৌন হেনস্থা, অপহরণের শিকার হচ্ছেন মেয়েরা। চলতি বছরের কয়েক মাস আগে এগরার উত্তর তাজপুরে চতুর্থ শ্রেণির এক নাবালিকা স্কুল ছাত্রীর উপর যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠে স্কুল শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুনঃ মন্ত্রিসভার অনুমোদনে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হচ্ছে আগামী সপ্তাহেই
কয়েক বছর আগে রামনগর থানার রাণিসাই থেকে সাইকেলে করে রাতে টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরছিল এক নাবালিকা ছাত্রী। অভিযোগ, ওই ছাত্রীকে বেশ কয়েকজন যুবক ধরে যৌন নির্যাতন চালায়। তবে ছাত্রীটি দৌড়ে পালিয়ে যায়।
প্রশ্ন উঠছে কতটা নিরাপদ জেলাবাসী? অভিযোগ, মহিলাদের নিরাপত্তা একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। সন্ধ্যা নামলেই জেলার বহু রাস্তাঘাট চলে যায় সমাজ বিরোধীদের দখলে। জেলার এগরা, পাঁশকুড়া, হলদিয়া, তমলুক পুরসভার বেশ কিছু ওয়ার্ডে বিকল পথবাতির সুযোগ নিয়ে রাস্তাতেই চলে চোলাই, জুয়া ও সাট্টার আসর। তবে শহরের বেশ কিছু ওয়ার্ডে সন্ধ্যার পর একা মহিলাদের পক্ষে রাস্তায় বেরোনো আতঙ্কের বলে দাবি শহরবাসীর একাংশের।
জেলার এক কলেজ ছাত্রী বলেন, “গ্রাম থেকে শহরে দিন দিন দুস্কৃতী দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। তবে পাঁশকুড়া, কোলাঘাট-সহ একাধিক ঘটনাই বুঝিয়ে দেয় মহিলাদের সুরক্ষা কতখানি।”
আরও পড়ুনঃ সহকর্মীদের গুলি করে নিজে আত্মঘাতী হলেন আইটিবিপি-র জওয়ান
এ বিষয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পার্থ ঘোষ বলেন, “হায়দ্রাবাদের ঘটনার পর থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি টহল বাড়ানোর ব্যাপারে জেলা পুলিশকে জানানো হয়েছে।” তবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশা। জেলার রামনগর, এগরা, দিঘা থানা এলাকা দিয়েই মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ওড়িশা। অথচ বাংলা থেকে ওড়িশা যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় রাতে কোনও পুলিশি টহল থাকে না বলে অভিযোগ।
এলাকা বাসীর অভিযোগ, সন্ধ্যার পর ওই সমস্ত এলাকা চলে যায় সমাজ বিরোধীদের দখলে। বলা বাহুল্য, এগরার পানি পারুল থেকে রামনগরের মীরগোদা গঞ্জ হয়ে ওড়িশা। আবার এগরার কসবাগোলা, গোপীনাথপুর, সাহাড়া হয়ে খুব সহজেই পশ্চিম মেদিনীপুর কিংবা ওড়িশা যাওয়া যায়। রামনগরের রাণিসাই, সন্তেশ্বরপুর, দেউলিহাট, বসন্তপুর, চন্দনপুর, মুকুন্দপুর হয়ে দ্রুত ওড়িশা পৌঁছানো সম্ভব হয়। অভিযোগ, বর্ডার এলাকায় এই সমস্ত রাস্তায় কোনও পুলিশি নিরাপত্তা একেবারেই নেই বলে দাবি এলাকাবাসীর।
স্থানীয় সূত্রের খবর, বছর দু’য়েক আগে দিনের আলোয় রামনগর থানার চন্দনপুরের কাছে দুস্কৃতীরা এক মোটর বাইক আরোহীর চোখে লঙ্কা গুঁড়ো মেরে তাঁর সোনার চেন, আংটি ও নগদ কয়েক হাজার টাকা ছিনতাই করে। আরও বহু ঘটনার সাক্ষী গোটা জেলাবাসী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাক্তি বলেন, “রাত হলেই পুলিশ গাড়ি ঘিরে তোলা আদায়ে ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়েই ওঁদের কি বা যায় আসে।”
আরও পড়ুনঃ আশাহত নাবালিকার মন রাখতে মাজারোই পরিবারের সাথে সাক্ষাতে ক্রাউন প্রিন্স
প্রসঙ্গত, কয়েক দিন আগেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলা হাসপাতাল চত্বরে অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে মদ্যপানের আসর চলার সময় পুলিশ হানা দিয়ে গ্রেফতার করেছিল চারজন অ্যাম্বুলেন্স চালককে। ওই ঘটনার জেরে রাতের বেলায় খোদ জেলা হাসপাতালে আসা রোগীর পরিজনদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ওই চালকদের অ্যাম্বুলেন্স চালানোর সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে উদ্বেগের কথাও জানিয়ে ছিলেন রোগীর আত্মীয়রা। তবে অসামাজিক কার্যকলাপ বাড়ার জন্য অনেকে রাজ্য সরকারের ঢালাও মদের লাইসেন্স প্রদানকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মদ ও মাদক দ্রব্য বিরোধী কমিটির আহ্বায়ক নারায়ণ চন্দ্র মাইতি বলেন, “সরকার ঢালাও মদের লাইসেন্স দিচ্ছে। পাশাপাশি এলাকায় রমরমিয়ে চলছে চোলাইয়ের কারবার। প্রশাসনিক নজরদারি নেই। নতুন প্রজন্ম নেশার প্রতি আসক্ত হয়ে বিভিন্ন সমাজ বিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে। প্রশাসনিক উদাসীনতার জন্যই এই ধরনের কার্যকলাপ বাড়ছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার ভি সোলেমান নেসাকুমার বলেন, “গণধর্ষণের মতো ঘটনার অপরাধ রুখতে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও বিভিন্ন অপরাধের মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারের তৎপরতা শুরু হয়েছে। জেলার প্রতিটি থানার পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584