শুভদীপ ভট্টাচার্য
কিছু জেদ বয়ে আনে প্রলয়ের বার্তা, ওলোট-পালট হয় সবকিছু। কিছু মৃত্যু এমন যা প্রায় টলিয়ে দেয় পাহাড় কেউ, কিছু আঘাত এমনও থাকে যা সুখস্মৃতির, আগামীর স্বপ্ন লুক্কায়িত থাকে তাতে, যেমন থাকে মেঘের মধ্যে বজ্র। তেমনভাবেই গড়ে ওঠে বহরমপুর কলেজ অধুনা কৃষ্ণনাথ কলেজ।
নবাবী আমলের চিন্তার রেশ জাতির চৈতন্যজুড়ে ছেয়ে থাকার কালেই দারুণ এক প্রতিস্পর্ধার জানান দিয়ে আধুনিক শিক্ষবিস্তারের মাধ্যমে সমাজচৈতন্যের প্রাচীন ভিত্তি ভেঙে নয়াকাঠামোতে গড়ে তুলবার স্বপ্ন দেখেছিল তরুণ দুটি চোখ।
বণিকি পুঁজির বিকাশের একদম বুনিয়াদি পর্বে পুরাতনপন্থী চিন্তাতে ছেদ টেনে পাশ্চ্যাত্যের ধারায় আধুনিক শিক্ষাবিকাশে তৎপর হয়ে ওঠে এক স্বল্পায়ু তরুণ-রাজা কৃষ্ণনাথ। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ইন্দ্র-চন্দ্র-বরুণেরা যখন পুরাতন চিন্তারই জাবর কেটে চলেছেন। বিপুল বৈভব ও সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বজায় রাখছেন সামন্ত ঠাঁটবাট। সেই সময়েই তুলনামূলক কম সম্পদের অধিকারী কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ রাজা কৃষ্ণনাথ দেখতে থাকেন এক আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। ইউরোপে যাতাযাতের সুবিধার জন্য জাহাজ নির্মাণ কারখানা গড়তে উদ্যোগ নেন। ছেদ পড়ে সে কাজে। কিন্তু থেমে থাকা তার স্বভাবেই নেই তাই স্বপ্ন দেখেন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের।
তারই স্বপ্নের পরিণতি হিসাবে গড়ে ওঠে বহরমপুর কলেজ অধুনা কৃষ্ণনাথ কলেজ। স্রোতস্বিনী খরস্রোতার সামনে খড়কুটোর মতোই উড়ে যায় প্রাচীনপন্থীদের বাধাদান, সংস্কারপন্থীদের ষড়যন্ত্র বা ব্রিটিশের দুরভিসন্ধি। জমির মালিকানা দখলের জন্য ছিল ব্রিটিশের দুরভিসন্ধি। সম্পত্তির মালিকানা ব্রিটিশ কুক্ষিগত করতে চাইলে উইলের বঙ্গানুবাদ করে স্বল্পায়ু কৃষ্ণনাথের বিধবাপত্নী স্বর্ণময়ীর পাশে দাঁড়ান বিদ্যাসাগর। বঙ্গানুবাদ করেন উইলের, বিরুদ্ধতার স্বর চরমে উঠলে ব্রিটিশ পিছু হটে। গড়ে ওঠে আধুনিক শিক্ষাদানের আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অচিরেই কেবল জেলা নয় বরং সারাদেশেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এই প্রতিষ্ঠানের।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বে স্থাপিত(১৮৫৩) এই কলেজ সারা দেশের আধুনিক শিক্ষাচর্চা ও বিস্তারের মাইলস্টোন হিসাবে পরিচিত হয়।
এরই সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও একটি অধ্যায়, সে অধ্যায়ও একটি ইতিহাস। মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজি সুভাষের স্মৃতিধন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বহরমপুর জেল থেকে কারামুক্তির পরে ‘বিদ্রোহী’ কবিকে সম্বর্ধনার গৌরবে ভাস্বর কলেজ ছাত্রদের মহিমা। মাস্টারদা সূর্য সেন, নলিনী বাগচী, বাঘাযতীন সহ অসংখ্য বিপ্লবীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও নিবিড় যোগ ছিল এই প্রতিষ্ঠানের। অথচ এইসমস্ত ইতিহাসকে কিছুমাত্র তোয়াক্কা না করে এবং একইসঙ্গে বর্তমান জেলার শিক্ষাপরিকাঠামো, প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রছাত্রীদের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি না রেখেই জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ধুয়ো তুলে, জেলার সকল মানুষকে অন্ধকারে রেখে কৃষ্ণনাথ কলেজকে অবলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় কলেজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কলেজ কর্ত্তৃপক্ষ সরকারকে অর্পণ করে দেয়। সার্কুলার জারি হয়, তাতে বলা হয়েছে, কৃষ্ণনাথ কলেজের জায়গায় চালু হবে ‘মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়’।
যদিও একথা সত্য, এ জেলাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবী দীর্ঘদিনের। রাজ্যের অধিকাংশ জেলাতেই বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও নবাবী আমলের পতনের পঞ্চাশ বছর পর আধুনিক শিক্ষায় মাথা তুলে দাঁড়ানো জেলায় এখনও অব্দি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ফলে শিল্পহীন অনগ্রসর এজেলা জুড়ে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। তাই সঙ্গত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি দীর্ঘদিনের কিন্তু এই জেলার মানুষ কখনও কৃষ্ণনাথ কলেজ অবলুপ্তির বিনিময়ে এ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় চাননি।বিজ্ঞান-কলা সহ বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স ও জেনারেল কোর্সে প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রীর পঠনপাঠনের কেন্দ্র এই কলেজ।
ন্যাক(NAAC) এর মূল্যায়নে A GRADE প্রাপ্ত একশো পয়ষট্টি বছরের এই কলেজের শিক্ষার মানও উন্নত। এইমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বহরমপুর তথা জেলার হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে বঞ্চিত করে একটা চালু কলেজ বন্ধ করার মাধ্যমে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষাব্যাবস্থা তার হিসেব নিকেশের দায় আপামর শিক্ষানুরাগীর। তারই সঙ্গে অঙ্ক কষে নেওয়া দরকার লাভ-ক্ষতিরও। একটা কলমের খোঁচাতে শিক্ষা সম্প্রসারণের অজুহাতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যত একলহমাতে এসে পড়ল অথৈ জলে। এ ক্ষতিপূরণের কোনো ভরসাযোগ্য জায়গাটুকুও রাখেনি সরকারি সার্কুলার।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে এ শিক্ষা সম্প্রসারণ না সংকোচন? প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তনী এবং বর্তমান ছাত্ররা। ধোঁয়াশা জারি রেখেই সরকারও গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুজু দেখিয়ে। কিন্তু বর্তমান ও প্রাক্তন অধ্যাপক, নানা স্তরের শিক্ষক, জেলার কবি-লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-সমাজকর্মীরাও তুলেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কেবল অস্তিস্ত্ব বিলোপ হচ্ছেনা একটি কলেজের। অতি সুগভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমের ইতিহাসের পাতাগুলি থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রতিষ্ঠা, আধুনিক শিক্ষার প্রচলন, মেরুদন্ড ঋজু রেখে লড়াইয়ের ইতিহাস, স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি। পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মের ভবিষ্যতও। এ বিশাল ক্ষতিপূরণের দায়ভার গ্রহণের উদ্যোগে তৎপর নয় সরকারি মহল, উদ্যোগী নয় কলেজ কর্তৃপক্ষও। তবু প্রতিবাদ রয়েছে জেগে।
বারবার নানামুনির নানামত প্রকাশিত হয়েছে, কখনওবা হয়েছে কোনো মনোজ্ঞ বিশ্লেষণও। পথে নেমে প্রতিবাদ, চিঠি-চাপাটি, আবেদন-নিবেদন এসবের স্তর পেরিয়ে কলেজের স্মৃতিরক্ষায় জনগণকে সামিল করে আন্দোলনের রূপরেখাও গৃহিত হয়েছে। এই বিশাল পাহাড়সম ক্ষতি রুখে দিতে বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবর্ষে দীর্ঘ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ‘নিভে যাওয়া দেউলটির প্রদীপের আগুনের মতো’ লেগে থাকা স্মৃতির আঁচে গা সেঁকে নিয়ে পদযাত্রা ও ডেপুটেনের ডাক দিয়েছে ‘কৃষ্ণনাথ কলেজ রক্ষা ও পৃথক পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রূপায়ন কমিটি’।
আরও পড়ুনঃ বিকলাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ালো কলেজ পড়ুয়ারা
শিক্ষা রক্ষায় সরকারের সদিচ্ছা, জনমানসের দাবী, আন্দোলনকারীদের লড়াই বাতলাবে আগামীর পথ। কিন্তু এই বিশাল চাপনউতোরের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ হবে কতখানি নাকি নিরপেক্ষতার সুর চিরতরে তলিয়ে যেতে দেবে এই বিশাল ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানকে তা ভাবনার দায় সকল শিক্ষাপ্রেমীর-শিক্ষাব্রতীর।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584