জীবনে প্রেম আসে বহুবার, সম্পর্ক হয় নায়িকাদের সঙ্গেও, দিলীপের শেষ সময়ে পাশে ছিলেন সায়রা বানু

0
149

মোহনা বিশ্বাস, বিনোদন ডেস্কঃ

Dilip Kumar

প্রয়াত বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কিং’ দিলীপ কুমার। বুধবার তাঁর মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হল। বলিউডে তাঁর অভিনয় জীবন প্রায় ছয় দশক বিস্তৃত হয়েছে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮। বলিউডের কিংবদন্তি এই অভিনেতা দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মুম্বইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। প্রয়াণের সময় দিলীপকুমারের পাশে ছিলেন স্ত্রী সায়রা বানু।

Dilip Kumar with Saira Banu
দিলীপ কুমারের পাশে স্ত্রী সায়রা বানু। সৌজন্যেঃ ইন্ডিয়া টিভি

দিলীপকুমার শুধু ‘ট্র্যাজেডি কিং’ নন, বলিউডের সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের সারিতে একবারে সামনের দিকেই তাঁর অবস্থান। চেহারা, ব্যক্তিত্ব, কণ্ঠস্বর-সব কিছুতেই এক বিশেষ আভিজাত্য ঘিরেছিল তাঁকে। দিলীপকুমারের জন্ম ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারে। বর্তমানে স্থানটি পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনওয়ালার অন্তর্ভুক্ত। তাঁর প্রকৃত নাম ইউসুফ খান। ইউসুফ থেকে দিলীপকুমার হয়ে ওঠার জার্নিটা মোটেই সহজ ছিল না। দিলীপের বাবা ছিলেন পেশোয়ারের একজন সফল ব্যবসায়ী। তবে বাবার সঙ্গে ছেলে ইউসুফের সম্পর্ক ভাল ছিল না। একদিন কথা কাটাকাটির জেরে বাড়ি ছেড়েই বেরিয়ে পড়লেন কিশোর ইউসুফ। বাড়ি ছেড়ে আসার সময়ে আলাপ হয় এক ক্যাফে মালিকের সঙ্গে। তারপর পাশে পেলেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতিকে।

Dilip Kumar
দিলীপ কুমার। সৌজন্যেঃআল জাজিরা

মাত্র পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। ব্যবসায়ী হওয়াই তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। ব্যবসা শুরু করার সূত্রেই আলাপ হয় জনৈক মাসানির সঙ্গে। তিনি দেখেই বুঝেছিলেন, ব্যবসা ইউসুফের জন্য নয়। তাঁর জায়গা অন্য কোথাও। এরপরই তাঁকে বম্বে টকিজে নিয়ে যান মাসানি। প্রথম দিকে ইউসুফ ছবির গল্প বাছাই এবং চিত্রনাট্য লেখার কাজে সাহায্য করতেন। ইউসুফ খুব ভাল জানতেন উর্দু। ফলে নিজের কাজে সুনাম অর্জন করতে তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি।

Jwar Bhata
ছবিঃ সংগৃহীত

১৯৪৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল অমিয় চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘জোয়ার ভাটা’। অভিনেত্রী দেবিকারানির প্রস্তাবে রাজি হয়ে এই ছবিতে জগদীশ-এর চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন ইউসুফ।এরপর দেবিকারানির পরামর্শে নাম পাল্টে ফেলেন ইউসুফ খান। ছবির জন্য তাঁর নাম হল দিলীপকুমার। শুরু হল বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কিং’ হয়ে ওঠার জার্নি।

Dilip Kumar in Shaheed
ছবিঃ সংগৃহীত

বক্সঅফিসে প্রথম সাফল্য পায় দিলীপ কুমার অভিনীত ‘জুগনু’। ১৯৪৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন বিখ্যাত নায়িকা ও গায়িকা নূরজাহান। পরের বছর ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শহীদ’ সিনেমাটিও ব্যাপক সাফল্য পায়। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘আন্দাজ’। রাজকাপুর, নার্গিস, দিলীপ কুমার অভিনীত ত্রিভুজ প্রেমের এই ছবিটি সুপার হিট হয়।

Legend Dilip Kumar
ছবিঃ সংগৃহীত

প্রায় ছয় দশক ধরে বিস্তৃত কেরিয়ারে দিলীপকুমার অভিনয় করেছেন ৬৩ টিরও বেশি ছবিতে। ‘আন্দাজ’, ‘দেবদাস’, ‘কোহিনুর’, ‘দাগ’, ‘জোগান’, ‘মধুমতী’, ‘মুঘল-ই-আজম’, ‘গঙ্গা যমুনা’, ‘রাম অউর শ্যাম’, ‘শক্তি’ , ‘মসান’, ‘ক্রান্তি’, ‘সওদাগর’-সহ অসংখ্য ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মন জয় করে নেন তিনি। হয়ে ওঠেন বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কিং’। তাঁর সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্র ছিল ‘কিলা’। যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৮ সালে। দিলীপকুমার অভিনেত্রী বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। তাঁরা উভয়েই একসাথে ‘গঙ্গা যমুনা’ সহ সাতটি সিনেমায় অভিনয় করেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে সবসময়ের জন্য বোঝাপড়া খুবই ভাল ছিল।

Dilip Kumar passed away
দিলীপ কুমার। সৌজন্যেঃ বিবিসি

শুধুমাত্র বলিউড নয়, বাংলা সিনেমাতেও দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছে দিলীপকুমার অভিনীত ‘সাগিনা মাহাতো’। ১৯৭০ সালে তপন সিনহা-র পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘সাগিনা মাহাতো’। সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দিলীপকুমার। বাংলা চলচ্চিত্রের দিলীপকুমারের এই একটা চরিত্র বাঙালির মনের মণিকোঠায় সর্বদা বিরাজমান। এমনকী পাকিস্তানেও কিংবদন্তী অভিনেতা সুনাম অর্জন করেছেন তাঁর অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে।

Dilip Kumar Kamini Kaushal
দিলীপকুমার-কামিনী কৌশল। ছবিঃ সংগৃহীত

দিলীপকুমার অভিনীত ‘শহিদ’-এ দিলীপকুমারের নায়িকা ছিলেন কামিনী কৌশল। এই ছবিতে অভিনয় করার সময়ই তাঁদের প্রেম হয়েছিল। যা সেইসময়ে বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে বহুচর্চিত বিষয় ছিল। দু’জনে বিয়ে করবেন বলেও ঠিক করেছিলেন। কিন্তু বাধা দেন কামিনীর দাদা। এই সম্পর্কে তিনি রাজি ছিলেন না। এরপরই ভেঙে যায় দু’জনর সম্পর্ক। সেই বছরই দুর্ঘটনায় নিহত দিদির দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেন কামিনী নিজের দিদির স্বামীকে বিয়ে করেন।

Madhubala Dilip Kumar
মধুবালা-দিলীপকুমার, সৌজন্যেঃ টাইমস নাও

এরপর দিলীপকুমারের জীবনে আবারও প্রেম আসে। মধুবালার প্রেমে পড়েন তিনি। দীর্ঘ সাত বছর চলেছিল তাঁদের প্রেমপর্ব। তারপর এই সম্পর্কও ভেঙে যায়। ছবির শুটিং লোকেশনে মধুবালাকে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না তাঁর বাবা। ১৯৫১ সালে দিলীপ কুমার ‘তারনা’ সিনেমায় একসাথে কাজ করেন। এরপর ১৯৬০ সালে ‘মুঘল-ই-আজম’ ছবিতে কাজ শুরু করার পরই মধুবালার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন দিলীপকুমার। এই প্রেম গভীর হলেও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একটি ছবির শুটিং লোকেশনে মধুবালাকে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না তাঁর বাবা। পরিচালক-প্রযোজক অনুরোধ করেন দিলীপকুমারকে। তিনি যেন কথা বলেন মধুবালার বাবার সঙ্গে। দিলীপকুমারের অভিযোগ ছিল, মধুবালার বাবা তাঁকে অপমান করেছেন। কিন্তু মধুবালার বক্তব্য যে তাঁর বাবাকে অপমান করেছেন দিলীপকুমার। এই চাপানউতরের জেরেই ভেঙে যায় দিলীপকুমার-মধুবালার প্রেম। ১৯৬০ সালেই কিশোর কুমারকে বিয়ে করেন মধুবালা।

Saira Banu
স্ত্রী-অভিনেত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে অভিনেতা দিলীপ কুমার। সৌজন্যেঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

এদিকে, ১৯৬৬ সালে দিলীপকুমার বিয়ে করেন সায়রা বানুকে। বিয়ের সময় দিলীপকুমারের বয়স ছিল ৪৪ বছর। আর সায়রা বানু-র বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। ছোটবেলা থেকেই দিলীপকুমারের অন্ধ ভক্ত ছিলেন সায়রা বানু। তাঁর স্বপ্নের নায়ক তাঁকে প্রথম দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। প্রথম আলাপে সায়রা বানুর রূপের প্রশংসা করেছিলেন দিলীপকুমার। একসময় সায়রা বানুও বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখলেন।

Saira Bnau Dilip Kumar
দিলীপ কুমার-সায়রা বানু। সৌজন্যেঃ ইন্ডিয়া টুডে

শোনা যায়, তখন রাজেন্দ্র কুমারের সঙ্গে তাঁর মৃদু ভাল লাগার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সায়রার মা, বিগত দিনের অভিনেত্রী নাসিম বানু তাঁদের এই সম্পর্ক মনে নেননি। এরপর নাসিম বানুই উদ্যোগী হন দিলীপকুমারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের। সায়রা বানুর মনে হয়েছিল, দিলীপকুমারকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তাঁর বহু দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হল। ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে দর্শককূল সকলেই সেই সময়ে বলেছিলেন, এই বিয়ে বেশি দিন স্থায়ী হবে না। কিন্তু নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করে দিলীপকুমার-সায়রা বানু দু’জনে দু’জনের পাশে ছায়া হয়ে পাঁচ শতকেরও বেশি দাম্পত্যজীবন কাটিয়েছেন।

Dilip Kumar Saira Banu
দিলীপ কুমার-সায়রা বানু। সৌজন্যেঃ ইন্ডিয়া টুডে

আটের দশকের গোড়ার দিকে বিবাহবিচ্ছেদ হয় দিলীপকুমার-সায়রা বানুর। পাকিস্তানের নাগরিক আসমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন দিলীপকুমার। শোনা যায়, তিনি সায়রা বানুকে ডিভোর্স করে বিয়ে করেছিলেন আসমাকে। যদিও সেই বিবাহ দু’বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। তারপর আবার সায়রা বানুর কাছে ফিরে আসেন দিলীপকুমার। ফের একবার বিয়ে করেন তাঁকে। দিলীপকুমার জীবনের শেষ সময়েও পাশে পেয়েছেন স্ত্রী সায়রা বানুকে। লেজেন্ড দিলীপকুমার যে প্রেমিক মানুষ ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবমিলিয়ে রঙিন ছিলেন বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কিং’।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here