নিজস্ব সংবাদদাতা, দক্ষিন দিনাজপুরঃ
আগামীকাল বুধবার লৌহদেব বিশ্বকর্মার পুজো। আর এই পুজো মানেই ঘুড়ি লাটাই আর দুপুরে জমিয়ে খাসির মাংস খাওয়া-দাওয়া।হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে বিশ্বকর্মা ছিলেন দেবশিল্পী।বিষ্ণুপুরাণের মতে প্রভাসের ঔরসে বৃহস্পতির ভগিনীর গর্ভে বিশ্বকর্মার জন্ম হয়।
বেদে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বকর্মা বলা হয়েছে। বিশ্বকর্মা মূলত সৃষ্টিশক্তির রূপক নাম।সেই অর্থে ইনি পিতা,সর্বজ্ঞ দেবতাদের নামদাতা।বিশ্বকর্মা সর্বমেধ-যজ্ঞে নিজেকে নিজের কাছে বলি দেন। বিশ্বকর্মা বাচস্পতি,মনোজব,বদান্য,কল্যাণকর্মা, বিধাতা।ঋকবেদের মতে ইনি সর্বদর্শী ভগবান। এঁর চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পা সর্বদিক বিদ্যমান।
বাহু ও পায়ের সাহায্যে ইনি স্বর্গ ও মর্ত্য নির্মাণ করেন।বিশ্বকর্মা শিল্প সমূহের প্রকাশক ও অলঙ্কারের স্রষ্টা,দেবতাদের বিমান-নির্মাতা।এঁর কৃপায় মানুষ শিল্পপকলায় পারদর্শিতা লাভ করে। ইনি উপবেদ,স্থাপত্য-বেদের প্রকাশক এবং চতুঃষষ্টি কলার অধিষ্ঠাতা।ইনি প্রাসাদ,ভবন ইত্যাদির শিল্পী।
ইনি দেবতাদের জন্য অস্ত্র তৈরি করেন।মহাভারতের মতে–ইনি শিল্পের শ্রেষ্ঠ কর্তা, সহস্র শিল্পের আবিষ্কারক, সর্বপ্রকার কারুকার্য-নির্মাতা।স্বর্গ ও লঙ্কাপুরী ইনিই নির্মাণ করেছিলেন ।রামের জন্য সেতুবন্ধ নির্মাণকালে ইনি নলবানরকে সৃষ্টি করেন।কোনো কোনো পুরাণ মতে, বিশ্বকর্মা বৈদিক ত্বষ্টা দেবতার কর্মশক্তিও আত্মসাৎ করেছিলেন।এই জন্য তিনি ত্বষ্টা নামেও অভিহিত হন।বিশ্বকর্মার কন্যার নাম ছিল সংজ্ঞা। যাঁর সাথে সুর্যের বিবাহ দেন।
সংজ্ঞা সুর্যের প্রখর তাপ সহ্য করতে না পারায়, ইনি সুর্যকে শানচক্রে স্থাপন করে তাঁর উজ্জলতার অষ্টমাংশ কেটে ফেলেন।এই কর্তিত অংশ পৃথিবীর উপর পতিত হলে,উক্ত অংশের দ্বারা বিশ্বকর্মা বিষ্ণুর সুদর্শনচক্র,শিবের ত্রিশূল, কুবেরের অস্ত্র,কার্তিকেয়ের শক্তি ও অন্যান্য দেবতাদের অস্ত্রশস্ত্রাদি নির্মাণ করেন।
বলা হয়ে থাকে,শ্রীক্ষেত্রের প্রসিদ্ধ জগন্নাথমূর্তি বিশ্বকর্মা প্রস্তুত করেন ।
বাঙালী হিন্দু গণ যে বিশ্বকর্মার মূর্তি পূজো করেন তিনি চতুর্ভুজা।এক হাতে দাঁড়িপাল্লা,অন্য হাতে হাতুরী,ছেনী,কুঠার থাকে।অবশ্যই এগুলি শিল্পের প্রয়োজনীয় জিনিষ,তাই শিল্প দেবতা বিশ্বকর্মা এগুলি ধারন করে থাকেন। দাঁড়িপাল্লার একটি কারন আছে।আমরা যদি দাঁড়িপাল্লা কে ভালো মতো লক্ষ্য করি দেখি সুপাশে সমান ওজনের পাল্লা থাকে।ওপরের মাথার সূচক যখন সমান ভাবে ঊর্ধ্ব মুখী হয়- তখন বুঝি মাপ সমান হয়েছে ।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বকর্মা পুজোর মন্ডপ উদ্বোধনে পরিবহনমন্ত্ৰী
এভাবে একটি পাল্লায় বাটখারা রেখে অপর টিতে দ্রব্য রেখে পরিমাপ হয়।এর তত্ত্ব কথা আছে।আমাদের জীবনের কাটাটি আত্মিক বিন্দুতে স্থির রাখতে হবে।দুই পাল্লার একদিকে থাকবে জ্ঞান আর কর্ম।
জ্ঞানের দিকে বেশী ঝুকে পড়লে কর্ম কে অবহেলা করা হবে পরিণামে আসবে দুঃখ, অভাব। আর কাটা কর্মের দিকে বেশী ঝুকে পড়লে তবে আসবে আধ্যাত্মিক অকল্যাণ।তাই কাটাতি দুয়ের মাঝে সমন্বয় করে রাখতে হবে। কোন দিকেই না যেনো বেশী ঝুকে পড়ে।এই নিয়ম না মেনে চললে বিশ্বপ্রেম, বিশ্ব ভাতৃত্ব সচেতনতা কোন টাই সম্ভব না।
বিশ্বকর্মার মূর্তি যদি আমরা দেখি,তাহলে দেখি তাঁর বাহন হস্তী।কলকাতার কর্মকার সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা শিক্ষা ব্রতী স্বর্গত হরষিত কেশরী রায় প্রথম বিশ্বকর্মার হস্তী বাহন বিগ্রহের পূজা করেন।হাতী কেন বাহন?পুরানের প্রনাম মন্ত্রে বিশ্বকর্মাকে মহাবীর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। হাতীর কতটা শক্তি তার আন্দাজ করতে পারি। নিমেষে গাছ পালা মাথা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়।
কারোর ওপর চরণ ভার দিলে তার মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মৃত্যু আর অস্থি সকল চূর্ণ চূর্ণ হবে।এমন প্রবাদ আছে, হাতী নাকি একটু বড় পাথর শুঁড়ে তুলে ছুঁড়ে মারতে পারে।প্রাচীন কালে রাজারা যুদ্ধে হস্তী বাহিনীর প্রবল ভাবে ব্যবহার করতেন । তাই এই মহা শক্তিমান প্রানী এই দিক থেকে মহা যোদ্ধা বিশ্বকর্মার বাহন হবার যোগ্যতা রাখে।
হস্তীর হাত নেই।তবে একটি কর বা শুন্ড আছে । কর আছে বলেই হাতীর এক নাম করী।কৃ ধাতু থেকেই কর শব্দটির উৎপত্তি। সে এই শুন্ডের সাহায্যেই গাছের ডাল টানে, জল খায়, স্নান করে । আবার দেখি শিল্পের মাধ্যমেই কর্ম সংস্থান । তাই বিশ্বকর্মা কর্মের দেবতা।এই শূন্ড দ্বারা কর্ম করা – এই দিক থেকে হস্তী একভাবে বিশ্বকর্মার বাহন হিসাবে মানানসই ।
হস্তীকে দিয়ে অনেক কাজ করানো হয় । বন দপ্তর হস্তীকে দিয়ে কাঠ সরানোতে কাজে লাগায় । মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি, কান্ড মাহুতের নির্দেশে হাতী এক স্থান থেকে আর এক স্থানে নিয়ে যায়, আবার কখনো সে গাছের ডাল বয়ে নিয়ে যায় মাহুতের নির্দেশে ।
আবার বন্য হাতীদের তাড়াতে বন দফতর পোষা হাতী গুলিকে কাজে লাগায়।হাতীর জীবনটাই এই রকম কাজের।নিজের খাদ্য আরোহণ থেকে, মাল বওয়া সব সময় কাজ ।
আর শিল্পের সাথে কর্মের সংস্থান জল আর ঠান্ডার মতো।জলে যেমন ঠান্ডা ভাব থাকে তেমনই কর্মের মাধ্যমেই শিল্পের বিকাশ।তাই বিশ্বকর্মা হলেন কর্মেরও দেবতা।এই দিকে থেকে শ্রমিক হাতী বিশ্বকর্মার বাহন হিসাবে একেবারে মানানসই ।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584