কেমন যেন টাইম মেশিনে চড়ে বড্ড তাড়াতাড়ি ভার্চুয়াল দুনিয়াতে চলে এসেছি আমরা। রেডিমেড-ইজিমেড এর যুগে এসে কেমন যেন ফিরে তাকানোর দিনগুলির দিকে চাইতে ইচ্ছে হয়।ছেলেবেলার দিনগুলো বোধহয় অনেক বেশী শিকড়ছোয়া ছিলো। কোথায় গেল সেই ছু কিৎকিৎ, কোথায় লাললাঠি, নীললাঠি র খেলা।চোরের লাঠিকে দূরে সরিয়ে ইঁট ছোঁয়ার আসায় চোট্টামি করা। ঢাকাই খেলা,চোর পুলিশ, গাইমার-পিলমার- ছড়ান ইত্যাদি গুলি খেলা,ডাঙ গুলি এরা তো চর্যাপদে স্থান পেতে চলেছে। খোখো, কিৎকিৎ,পাঁচ গুটির খেলা, “এলাটিন বেলাটিন সইলো, কিসের খবর পাইলো, রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো”-এ আক্ষেপের হা হুতাশ রান্নাঘরের আনাচে কানাচে ঘোরে। হাত ধরে গোল্লাছুট খেলে ডজ মেরে রাস্তা ছোঁয়ার উত্তেজনা কি ছিলো বোঝানো বড় মুশকিল!বালির গাদায় ঘর বানিয়ে ভেঙে ফেলা, আবার গড়া-এ পাগলামিতে অন্য সৃষ্টিশীলতা ছিল।সাইকেলের রডে বগল ঝুলিয়ে হাফ প্যাডেলে প্রথম এডভেঞ্চার শুরু, আজকের মতন দুদিকের সাপোর্টস্ট্যান্ড ওয়ালা সাইকেল তখনো বাজারে আসেনি। গাছে উঠে আম জাম পাড়ার সময় একটুও বুক কাঁপেনি হাত পা ভাঙার ভয়ে, আর আজ সেই আমিই ছেলের লাফঝাঁপ বেশী দেখলেই অজানা আতঙ্কে ভুগি। পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা আটার বা কেঁচোর চার দিয়ে। ফাতনা টুক টুক করে লাগাতার ঠোকর খেলে পুঁটি, এক দুবার ঠোকর খেয়ে আচমকা টান মানেই বড় মাল, আর এক ঝটকায় ডুবিয়ে নিলেই নীঘাৎ তেলাপিয়া।আমাদের সন্তানদের দৌড় যে ফিশফ্রাই আর ফিশ ফিংগারের মধ্যেই লটকে রইলো। কচি পাঁঠার ঝোল কে কাবাব বানিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে গেলাচ্ছি আমরা।রুটির মাঝে ঝোলাগুড় পাকাতে পাকাতে কবে যে চিকেন আর মটন রোল সলতে পাকিয়ে ফেললো কে জানে?চালের গুঁড়ো পিঠে পুলির চৌহদ্দি পেরিয়ে লাক্টোজেন আর নেস্টম এর কৌটায় বন্দী হলো কে জানে? বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল, নোনা আর নারকেল কাঠের ব্যাট দিয়ে গাভাসকার হওয়ার ভগ্ন স্বপ্ন আজ মোবাইলের ক্রিকেট অ্যাপস এই ঢুকিয়ে ফেলেছি। বাড়ীর অন্দরমহলের লুডো বা কাটাকুটি খেলা আজ বহির্জগতের মোবাইলেই বেশী মানানসই। বায়োস্কোপের ঢাকনা খুলে ভেতরে সিনেম্যাটিক দুনিয়ার বিস্ময়কর আবরণ সাদাকালোর হারানো সুর গেয়ে, নাগিন বাঁশী বাজাতে বাজাতে এইচ ডি ওয়ার্ল্ডের দরজায় বাহুবলী হযে কড়া নেড়ে দিয়েছে ভাবার অবকাশ হয়নি। শীতের সার্কাসের জীবজন্তু মায় কুশীলবরা আজ কোথায় মুখ লুকায় কে জানে! মড়ার খুলি সম মাউথ স্পিকার এর ওপর রুমাল ঢেকে যাত্রাপালা বা সিনেমার জন্য হেঁকে যাওয়া চরিত্রগুলো কোথায় যেন ফ্লেক্স এর আড়ালে নিজেদের ছায়া খোঁজে। আকাশবাণী র স্থানীয় সংবাদ আর গল্প দাদুর আসর আজ জমিয়ে রেখেছে কোনও এক এফ রেডিও. বেঙ্গমা-বেঙ্গমী র কল্পলোক রামায়ণ-মহাভারত এর কৌলীন্য মাড়িয়ে অরণ্য দেব-মানড্রেক-টিনটিন এর আঙিনায় পা ফেলে কবে এসে ঘরের মাঝে সিনচান আর অ্যাংরি বার্ডস হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে তার হিসাব তো সময়ও ধরে রাখতে পারেনি। এলুমিনিয়ামের সেই বইয়ের বাক্স টনের বোঝা হয়ে আমাদের সন্তানদের মেরুদন্ড ঝুঁকিয়ে দিয়েছে তার খবর কি আমরা রাখি? জীবনযুদ্ধে সফলতার সিঁড়ির স্বপ্ন দেখায় আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শপিং মলের এসকালেটরে চড়িয়ে।সামাজিকতার মেলবন্ধন সোশ্যাল মিডিয়ার হ্যাশ ট্যাগ, লাইক, শেয়ার আর কমেন্ট গুলিয়ে সম্পর্কের জটিলতায় আবর্ত হচ্ছে, তাতে ভয় হয়, এদের পরবর্তী প্রজন্ম সরাসরি ডাউনলোডেড হবে না তো?
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584