এক যে ছিল জীবন-তাপস দাস
উত্তর দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ অংশে রাজবংশী সম্প্রদায়ের বাস। ভাষাগত দিক দিয়ে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এমন কি দক্ষিণ দিনাজপুরের রাজবংশী মানুষের সাথে তফাত আছে এই জেলার রাজবংশী জন গোষ্ঠির। কথায় আছে প্রতি আট মাইলে ভাষা বদলে যায়। উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া, ইসলামপুর, চাকুলিয়া, গোয়ালপোখার, করণদীঘি, হেমতাবাদ, ইটাহার, কালিয়াগঞ্জ, রায়গঞ্জ প্রতিটি ব্লকে দেশীয় মুসলমান আর রাজবংশী সম্প্রদায় গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
দুই সম্প্রদায়ের যাপন বিজ্ঞাপনহীন চিরায়ত। রাজবংশী মেয়ের ধরম বাপ মুসলমান পিতা। রাজবংশী দিনকাটু আর আকালু সেখ “সংরা”(মিতা)। দেখা যেত একজনের মেয়ের বিয়েতে আর একজন যৌতুকের সাইকেল, গরু দিত। সেই জীবন আর নেই। সময় ব্যস্ততা ভাঙ্গন আর অনিবার্য ভাবে অবিশ্বাস রাম আর আল্লার লড়াই পাঁচিল তুলে দিচ্ছে। সব রং ফিকে হয়ে আসছে।
জীবনের অন্তরঙ্গ লোকায়ত বিনোদন বদলে যাচ্ছে। বলা ভালো হারিয়ে যাচ্ছে। দুর্গাপুজোর সময় গ্রামে রামায়ণ গানের আসর বসতো। এক রাম পেটের দায়ে পাঞ্জাবে পানিপথে মিলে কাজ করছে। রাবণ মোবাইল ঘাঁটছে। সিতার এসব অভিনয় আর ভালো লাগে না। পুজোর সময় সে প্রথম পুরষ্কার রঙ্গিন টিভি ড্যান্স কম্পিটিশনে কাটা লাগা নাচে। দিনাজপুর খন গানের ।
চোর চুরনি গানের। হেন্ডেল সরি ট্যান্ডেল বাউদিয়া, হাজি বড় পাঁজি সাধু বড় শয়তান গানের আসর বসত। এখন অতিত। কালী পুজোর সময় বাড়ির সামনে সাতদিন ধরে রঙিন বাতি জ্বলত । লম্বা বাঁশের মাথায় দড়ি দিয়ে টাঙানো রঙ্গিন কাগজে মোড়া ছয় কোণা বাতি। সন্ধে হলেই পূর্ব পুরুষের জন্য আলো। পাট কাঠি আর কাশ দিয়ে লম্বা লম্বা হুকা হুকি। পুজোর রাতে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে হুকা হুকি খেলতাম। ” হুকা রে হুকি রে দাদো দাদি আলয় লে।” মাঝ রাস্তায় পাটকাঠি থেকে ফুলকি দিয়ে নামতো আগুন, আমরা ছুড়তাম আরো ওপরে, অনেক ওপরে। শেষে আগুন ডিঙ্গিয়ে বাড়ি ফেরা।
পরের দিন রাখাল পূজা। চাষের কাজে বাড়িতে যে ‘হালি‘ থাকতো। তাকে কালি কাজলে সাজিয়ে মিষ্টি মুখ করানো হতো। আশ্বিনের শেষে দিন বাড়ির হালির সাথে মাঠে যেতাম জমিতে ডাক দিতে। সূর্য ডোবার আগে পরে দুধ কলা, ঘি প্রদীপ জ্বালিয়ে মাঠে নিশিপূজা। তারপর দিন সকালে শিশির পড়তো। বেতের কাঠায় সিঁদুর “দল” ধূপকাঠি নিয়ে সূর্য ওঠার আগেই হেমন্তের ধান ক্ষেতে সোনালী শিষে সোরা সোরা পূজা।
” সোরা সোরা লাই লুই দূর পালা তিৎ ফড়িং দূর পালা পকা মাকড় দূর পালা হাঁসের ডিমা কচুর ফুতি আয় মা লক্ষ্মী হামার ভিতি।”
“দল” ছিটিয়ে আলে ধূপকাঠি প্রদীপ জ্বালিয়ে ফিরে আসতাম। এত ইঁদুর দৌড় ছিল না। রাতে শুষেন ডাকাত আসতো দলবল নিয়ে । হাতে চাবুক নিয়ে বলতো – ” বলো সুন্দরী ভালো বাসবে কি না?” নায়িকা উত্তর করত না না । ডাকাত সর্দারকে দশ টাকা দিয়ে বিদেয় করতেন বাবা। ডাকাত দলের সাথে চলে যেতাম মেহেবুবদের বাড়ি। সেখানে মাদুর পাতা থাকতো। চেমঠোল দা মুখে খৈনি নিয়ে আবার শুরু করতো – ”বলো সুন্দরী ভালোবাসা দিবে কি দিবে না?” সেই লোকায়ত জীবন আজ আলোকবর্ষ দূরে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584