অমিতাভ থেকে গান্ধি:বিনোদনে ভরপুর : তবু জমলো কই?
ফিরাঙ্গি
পরিচালক : রাজীব ধিংরা
অভিনয় :কপিল শর্মা, রাজেশ শর্মা, ইশিতা দত্ত, এডওয়ার্ড সোনিবিলক, কুমুদ মিশ্র, ইনামউল্লা, অঞ্জন শ্রীবাস্তব
⭐⭐⭐
৫/ ১০
রাজীব ধিংরা পরিচালিত ফিরাঙ্গি ছবিটি একটি পিরিয়ড কমেডি ড্রামা। ছবিটি K9 Film এর ব্যানারে প্রযোজনা করেছেন টিভি-র জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা কপিল শর্মা। কমেডি উইদ কপিল শো-এর সঙ্গ কম বেশি সব টিভি-র দর্শক পরিচিত। তিনি নিজেও এই ছবিতে মুখ্য অভিনেতার ভূমিকায়।
১৯২১ সাল। প্রাক স্বাধীনতা পর্বে পঞ্জাবের দুটি গ্রাম বেহরমপুর আর নকুগুড়া। কাছের রেল স্টেসন রসুলপুর। গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে গোটা দেশ উত্তাল। সেই পটভূমিতে দেশপ্রেমের মোড়কে একটি সরল প্রেমকাহিনি বলতে চেয়েছেন পরিচালক।
ছবির শুরুটা মনে করিয়ে দেয় লগন ছবিটিকে। এখানেও অমিতাভ বচ্চন সূত্রধর হিসেবে কাহিনির শুরুটা ধরিয়ে দিয়ে যান তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বাচনে। আর উন্মোচিত হতে থাকে পঞ্জাবের একটি গ্রামের ব্যস্ততার ছবি।
ফিরাঙ্গি ছবির কাহিনি উপস্থাপনটি এইরকম : ১৯২০ পঞ্জাবের বেহরমপুর নামে একটি গ্রাম। এই গ্রামে বাস করে মাঙ্গা নামে একটি সরলমতি বেকার যুবক। তার স্বপ্ন সে পুলিসের চাকরি করবে। কিন্তু বারবার সে ব্যর্থ হয়। একদিন প্রিয় বন্ধু হীরা-র বিয়েতে সে পাশের গ্রামে যায় আর সেখানেই ঐ গ্রামেরই মেয়ে সরগিকে তার ভালোলাগে। নানাভাবে সে সরগির মন পাওয়ার চেষ্টা করে। তার সরলতা সকলের পছন্দ। কিন্তু মাঙ্গা বেকার তাই সরগির পরিবার রাজি হয় না। মনের দুঃখে মাঙ্গা ফিরে আসে।
একদিন আশ্চর্য একটি ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার ড্যানিয়েল কোমরের ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়লে ডাক পড়ে মাঙ্গার। কারণ জন্মসূত্রে সে পেয়েছে এক ক্ষমতা। ফুঁ দিয়ে পশ্চাৎদেশে এক লাথি মারলেই কোমড়ের ব্যথা গায়েব। আরামের জবাবে ড্যানিয়েল তাকে পুরস্কৃত করতে চাইলে মাঙ্গা চাকরির নিবেদন করলে তার আর্দালির চাকরি মঞ্জুর হয়।
এইবার সে সরগিকে বিয়ে করতে পারবে। পাকা কথা সময়ে নারাজ হয় লালাজি (অঞ্জন শ্রীবাস্তব) সরগির নানাজি। কারণ মাঙ্গা ফিরাঙ্গিদের অধীনে চাকরি করে। মাঙ্গা নানাজিকে বোঝাবার চেষ্টা করে ইংরেজ বা ফিরাঙ্গি মাত্রেই খারাপ নয়। কিন্তু গান্ধিবাদি এই মানুষটির অনিচ্ছায় তাদের বিয়ে হয় না।
এরপর কাহিনিতে আসে অন্য টানাপোড়েন। অফিসার ড্যানিয়েল চতুরভাবে রাজা ইন্দ্রদেবকে রাজি করান গ্রামে শিল্প স্থাপনে। মদের কারখানা। ব্যক্তি স্বার্থে সামন্তপ্রভু ও বুর্জোয়া শক্তির প্রতিনিধি এক হয়ে যায়। রাজার অক্সফোর্ড পড়ুয়া মেয়ে একটু ভিন্ন রুচির। তাকে বিয়ে করার শর্ত রাজা লাভের ৬০ শতাংশ আর ড্যনিয়েল ৪০ শতাংশ।
তারা কারখানার জন্য নির্বাচন করে সরগিদের গ্রাম নকুপুড়াকে। কিন্তু গ্রামের মানুষ এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে অহিংসভাবে রুখে দাঁড়ায়। মাঙ্গা এই সুযোগটাকে কাজে লাগায়। যদি উচ্ছেদ রদ করা যায় তাহলে সে গ্রাম তথা সরগির বাবা -র কাছে ভালো হবে। তাই আলোচনার নামে গ্রামের সকলকে নিয়ে সে রাজার কাছে যায় জলসা-তে। সেখানে নর্তকির যৌন বিভঙ্গ, মাদকতা, সুরা, গানে সকলেই মোহিত হয়ে যায়। মাঙ্গাসহ গ্রামের সকলকে মদের নেশায় আচ্ছন্ন করে টিপ সই দিয়ে নেয় রাজার লোকেরা। অার পকেটে দিয়ে দেয় জমির দামের টাকা।এই নক্কারজনক কাজের জন্য সকলেই দায়ি করে মাঙ্গাকে। সে বেচারি ভালো করতে গিয়ে আরো বিপদে পড়ে যায়। শহর থেকে উকিল নিয়ে ফিরে এসে সব শুনে লালাজিও তাকে দোষি ঠাওরায়।
সরগি-কে পাওয়া কি তার হবে না? ড্যানিয়েলের কাছে গিয়ে সে অনুরোধ জানায় ও অপমানিত হয়। নানাভাবে উচ্ছেদ বিলম্বের চেষ্টা করে যায় মাঙ্গা। তারপর মরিয়া হয় সে। সরগিকে তাকে পেতেই হবে। সরগির চোখেমুখে তার প্রতি ভরসা। কি করবে সে? কি করলো সে? তার জন্য ছবিটি দেখতে হবে।
অভিনয়ে গোটা ছবি জুড়ে মাঙ্গারূপি কপিল শর্মা। ভোলাভালা সরল সরস এই কমেডি চরিত্রটি রূপায়ণ করতে যে দক্ষতা দরকার তা কপিলের নেই স্বীকার করতে হবে। তবু তিনি চেষ্টা করেছেন। কয়েকটি জায়গা উতরেছে আবার কমেডি কপিল বেরিয়ে এসেছে কোথাও।
সরগি-র চরিত্রে ইশিতা দত্তকে চমৎকার মানিয়েছে। এটা তার দ্বিতীয় ছবি। সরলতা প্রকাশে আর পরিমিত অভিনয়ে তিনি সম্ভাবনাময়।
অন্যান্য কয়েকটি চরিত্রে অভিনয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তারা সকলে মিলে ছবিটিকে টেনে নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে আছে লালাজির চরিত্রে অঞ্জন শ্রীবাস্তব, সরগির বাবার চরিত্রে রাজেশ শর্মা, রাজার চরিত্রে কুমুদ মিশ্র। মাঙ্গার বন্ধু হীরার ভূমিকায় অসম্ভব জীবন্ত অভিনয় করেছেন ইনামউল্লা ও ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার ড্যানিয়েলের চরিত্রে এডওয়ার্ড সোনিবিলকের টাইমিং অপূর্ব। রাজার মেয়ে শ্যামলির ভূমিকায় মনিকা গিল আভিজাত্য ও বাচনে যথাযথ। ছোট্ট মেয়ে নিমো-র ভূমিকায় রোশনি ওয়ালিয়া সুন্দর।
আগেই বলেছি লগন ছবির প্রভাব এছবির সবখানে। ক্যামেরাতেও তা লক্ষ করি। নভনীত মিশ্র-র ক্যামেরার কাজ সাবলীল। কয়েকটি টপ শট, ক্রেন শটে তিনি অনবদ্য। রাতের গ্রাম অথবা নদীর তীরবর্তী গ্রামের নিসর্গ তার ক্যামেরায় কথা বলে উঠেছে যেন।
এই ছবির সংগীত নির্মাণ করেছেন যতীন্দর শাহ। মোট ছটি গান আছে। গানের সুরে পঞ্জাবি সংস্কৃতির আবহ ধরা পড়েছে। সুনিধি চৌহানের ওয়ে ফিরাঙ্গি, রাহত ফতে আলির সাহিবা রুস গায়িয়া, মমতা শর্মার গুলবদন ও জ্যোতি নুরানির সজনা শোনে জিয়া গানগুলি ছবির আখ্যানের মেজাজটুকুকে তুলে ধরেছে।
ফিরাঙ্গি ছবিটির ভিতর ভালো ছবি হয়ে ওঠার কিছু সম্ভাবনা ছিল কিন্তু অগোছালো শিথিল আখ্যান আর পিরিয়ড পিস হিসেব দুর্বলতা তা হতে দেয়নি। সেট কাঁচা হাতের তৈরি। নদী তীরে নকুপুড়া গ্রামটিকে সজানো মনে হয়েছে। যেন তুলে এনে সিনেমার জন্যই বোঝা যায়। কস্টিউম তৈরিতে সাবকি ভাবনা নেই। কয়েকজন গ্রামবাসির অসহযোগ আন্দোলন, বিদেশি কাপড় পোড়ানো আারোপিত মনে হয়। ফিরাঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই কিন্তু ড্যানিয়েলসহ তাদের আচরণ এত শান্ত বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ছবির শেষে গান্ধিজিকে দেখে যে সমীহ তাও কৃত্রিম।
ছবিটিতে আদ্যপান্ত বিনোদনের মশলা : ন্যারেটর ও প্রলোগ হিসেবে অমিতাভ বচ্চন, রাজকীয় অাড়ম্বর, ছবির মতো গ্রাম, কমেডি, নর্তকির নৃত্য, গান, অ্যাকসন, কার চেজিং,ইমোসন, প্রেম, একেবারে ছবির শেষে গান্ধিজির আগমন সবই আছে। কিন্তু কীভাবে তাকে সাজাতে হবে সেই কায়দাটা পরিচালক শিখে উঠতে পারেননি। ফলে দীর্ঘ (১৬৬মিনিট) এই ছবি গতি আর শিথিলতার ভারসাম্য রাখতে পারেনি। অভিনয় দিয়ে সেটা পোষাতে পারতেন কপিল কিন্তু সেই বিদ্যায় তিনি এখনও পিছিয়ে আছেন।
ফিরাঙ্গি ছবিটি দেখতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার রাজীব ধিংরা বেশ কয়েকবার লগন, স্বদেশ ছবিটি দেখেছেন আর কপি করেছেন। শুধু একটাই অভিনবত্ব ব্রিচ বর্ন পিপল -এর ব্যাপারটি। লোকশ্রুতি তাদের লাথির আঘাতে ব্যাক পেন ভালো হয়ে যায়। কপিলের বড় ভাই এইরকম এক ব্রিচ বর্ন লোক। এটা রাজীবকে উৎসাহিত করে থাকবে আখ্যান রচনায়। ছবির এটাই Trivia.
ফিল্ম সমালোচক :ডঃ মানবেন্দ্রনাথ সাহা
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584