প্রীতম সরকারঃ
থর মরুভূমিতে দু-রাত থাকবো, সেই পরিকল্পনা সেখানে যাওয়ার আগেই করে নিয়ে ছিলাম। সেই পরিকল্পনা মতো থর মরুভুমির খুরি গ্রামে একটা ‘সুইস টেন্ট’ আগে থেকেই বুকিং সেরে রাজস্থানের জয়সলমীর থেকে দুপুরের খাবার খেয়েই রওনা হয়ে গিয়েছিলাম।
ভারতের একদম পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত জয়সলমীর ভারত-পাকিস্থান সীমান্তের শেষ শহর। জয়সলমীর থেকে থর মরুভূমির ভিতরে খুরি গ্রামের দুরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। রাজস্থান বেড়াতে এসে অনেকে ‘সাম’ গ্রামে রাত কাটান। সেখানে মরুভুমিতে বেশ পর্যটকের ভিড় থাকে, সেখবর আগেই নিয়েছিলাম।
ভিড় এড়াতে মরুভুমির নির্জনতা উপভোগ করতেই অপেক্ষাকৃত ‘ফাঁকা’ খুরি গ্রাম আমার পছন্দ ছিল। এবারও আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী এবং মেয়ে রয়েছে।জয়সলমীর থেকে দু-দিনের প্রয়োজনীয় নিজস্ব কিছু খাবার-দাবার-পানীয় সঙ্গে নিয়ে মরুভুমির ভিতর দিয়ে রওনা দিলাম কালো পিচ রাস্তা ধরে। সময়টা ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস। পূজোর ঠিক পরে।
মরুভূমির গরম এড়াতে জয়সলমীর থেকে এয়ার কন্ডিশন্ড গাড়ি নিয়ে খুরি গ্রামে যাওয়ার পথে রাস্তার মরিচিকা দেখে আন্দাজ করতে পারছিলাম, বাইরে কি পরিমান গরম রয়েছে। মরুভূমিতে দুপুরে গরম থাকবে, সেটা তো স্বাভাবিক। তবে আমরা সিনেমাতে যে ধরনের মরুভুমির ছবি দেখে অভ্যস্ত, রাজস্থানের থর মরুভুমির কিন্তু চরিত্র অনেক আলাদা। ধু ধু বালিয়ারি থাকলেও সবুজের রেশ বেশ দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট কাঁটা ঝোপের জঙ্গল। বালির উপরে হাল্কা সবুজ ঘাস, যা অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা এলাকাতে ছড়ানো।
মাঝেমাঝে আমাদের গাড়ি উটের দলকে ‘ওভারটেক’ করছে। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে পড়ছে দু – একটা রাজস্থানী গ্রাম্য কুঁড়ে ঘর। লোকজন রাস্তায় প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের গাড়ি চলছে তো চলছেই। মাঝে তো ভয়ই পেয়ে গেলাম। খুরি গ্রামের যে কটেজ আমরা দু-রাত থাকার জন্য বুকিং করেছি ইন্টারনেটে, তার আদৌ অস্থিত্ব রয়েছে তো! শেষের দিকে তো রাস্তার ধারে কাঁটা ঝোপ বাদে আর কিছুরই দেখা মিলছে না।হঠাৎ নজরে এলো মরুভূমির মাঝে মাটির নীচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এলাকা।
আরও পড়ুনঃ “ জারোয়াদের দেশে ”
প্রাচীরের বাইরে থেকেই নজরে পড়ছে পাশাপাশি বেশ কয়েকটা তাঁবু। প্রাচীরের সীমানা ঘেঁষে উড়ছে রং-বেরঙের নানা একরঙের পতাকা। তাহলে কি আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি ! গাড়ি থামিয়ে নেমে সেখানে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, খুরি গ্রাম সেখান থেকেও বেশ কিছুটা দূরে।
আর আমরা যে তাঁবুতে রাতে থাকার জন্য বুকিং করেছি, তার অস্তিত্বও রয়েছে। কিছুটা মনকে শান্ত করে রওনা দেওয়ার পরে খুরি গ্রাম এলো। একদম রাজস্থানী ঘরানার মরু গ্রাম বলতে যা বোঝায়, সেই গ্রাম সেরকমই। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম আমাদের সেই তাঁবুওয়ালা হোটেলটিকেও। সঙ্গের গাড়ি আমাদের সেখানে নামিয়ে আবার জয়সলমীর ফিরে গেল।
তাঁবুর অফিসঘরে পৌঁছে জানতে পারলাম, আমাদের তিনজনের আসার খবর সেখানকার তাঁবু মালিকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সেই রাজস্থানী জাঠ সম্প্রদায়ের তাঁবু মালিকের নাম জিজ্ঞেস করতেই ভিমরি খেলাম। জানলাম তাঁর নাম শয়তান সিং। এরকম নাম মানুষের হয় ! খুরি গ্রামেই সপরিবারে থাকেন শয়তান সিং। বছরের আট মাস এই তাঁবু চালান। তাঁর তাঁবুর অতিথি অধিকাংশই বিদেশি পর্যটক।
তবে সেদিনের জন্য ‘বাঙ্গাল’ থেকে কয়েকজন টুরিষ্ট এসেছেন। ব্যবহারে অমায়িক এই রাজস্থানী লোকটি বেশ অতিথিপরায়ন। তিনি নিজেই আমাদের জন্য রাখা সুইস টেন্টে লাগেজপত্র নিয়ে গিয়ে রাখলেন। আমাদের তিনজনকেই ‘ওয়েলকাম ড্রিংক’ দিয়ে স্বাগত করলেন। আমার জন্য আলাদা পানীয়, আর আমার পরিবারের জন্য আলাদা। বুঝলাম, আথিথেয়তার কম হবেনা।
তাঁবুর ভিতরে ঢুকে চক্ষু চড়ক গাছ হওয়ার জোগাড়। কি নেই তাঁবুর ভিতরে ! রট আয়রনের ডবল বেড খাট, সোফা সেট, বেড সাইড টেবিলে ফুলদানি, মেঝেতে পারসিয়ান কার্পেট। আমরা যেহেতু তিনজন, সেকারনে আমাদের তাঁবুতে আগে থেকেই একটা আলাদা সিঙ্গল বেড খাট পেতে রাখা হয়েছে। লাগোয়া টয়লেট।
সেখানে সুসদৃশ্য ওয়াশ বেসিন, বাহারি তোয়ালে, কমোড। মরুভুমিতেও টয়লেটে জলের কোন কমতি নেই। যাইহোক, আমরা সেসব দেখতে দেখতে তাঁবুর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, নানা রঙ্গের পাগড়ি মাথায় বড় বড় গোঁফওয়ালা লোকেরা তাদের উট নিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে হাজির হয়েছেন। উদ্দেশ্য, টুরিষ্টদের উটে চাপিয়ে মরুভূমি ঘুরিয়ে দেখানো। শয়তান সিং এর এখানে মোট আটটি এরকম তাঁবু রয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটি দখল করে রেখেছেন বিদেশি টুরিষ্টরা। বাকি দুটিতে এসে উঠেছেন জলপাইগুড়ি এবং হাওড়ার দুটি পরিবার। মরুভুমিতে এসে উটে চাপবো না, এটা হতে পারেনা। কাজেই আমরা তিনটি উটে চেপে রওনা হলাম মরুভূমিতে সুর্যাস্ত দেখতে। হাতের ঘড়ি সময় দেখাচ্ছে সন্ধে সাড়ে সাতটা।
কিন্তু আকাশের সূর্য বলছে, অস্ত যেতে তখনও ঢেড় দেরি। উটে চাপার সময় ফেলুদা গল্পের সেই লালমোহনবাবুকে শেখানো ‘উক্তি’টি মনে রেখেছিলাম। কিছুদূর নিয়ে গিয়ে উটের মালিকের ছেলে উটটিকে থামিয়ে দিল। সেখানে দেখলাম আমাদের তাঁবুতে এসে ওঠা অনেক টুরিষ্ট রয়েছেন। যেখানে এসে থেমেছি, সেই উঁচু বালির ঢিবির উপর থেকে নাকি ভালো সূর্যাস্ত দেখা যায়।কিন্তু হঠাৎ দেখলাম পশ্চিমের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে। উটওয়ালা জানালো, সেদিন সূর্যাস্ত দেখা যাবেনা। কারন আকাশ বলছে জয়সলমীরে জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। দার্জিলিং এর টাইগার হিলে গিয়ে ভোরে সূর্য ওঠা না দেখার অভিজ্ঞতা কয়েকবার হয়েছিল। কিন্তু থর মরুভূমিতে অক্টোবর মাসে সূর্যাস্ত দেখতে পাবোনা সেটা ধারনা ছিলনা।
যেহেতু আমরা খুরি গ্রামের ওই তাঁবুতে আরও একদিন থাকবো, সেটা শুনে অভিজ্ঞ উটওয়ালারা আশ্বস্ত করে আমাদের তাঁবুতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। এবার রাতের মরুভূমিতে রাতের অনুষ্টান। শয়তান সিং এর মুখে আগেই শুনে ছিলাম, রাতে তাঁবুগুলির মাঝের জায়গাতে চারদিকে গোল হয়ে চেয়ারে বসে মাঝের জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে স্থানীয় শিল্পীরা নাচ দেখান -গান শোনান। সঙ্গে সন্ধ্যের চা-জলখাবার দেওয়ার ব্যবস্থা সেখানেই থাকে।
সঙ্গীতানুষ্টান শেষ হতেই রাতের খাবার সেখানেই দেওয়া হয়। থর মরুভূমিতে সন্ধ্যে নামতেই শুরু হলো রাজস্থানী-হিন্দি মিলিয়ে গান এবং সঙ্গে স্থানীয় নৃত্য। এক রাজস্থানী মহিলা নাচতে নাচতে অদ্ভুত ব্যালান্সে মাথায় বেশ কয়েকটা হাড়ি পরপর বসিয়ে নেচে চললেন। বসলেন, ঘুরে ঘুরে নাচলেন।
ব্যালান্স করে হাড়ি মাথায় নিয়েই বালিতে রাখা একটি গ্লাস থেকে টাকা মুখে তুলে নিলেন। নাচ-গান চলছিল ঠিকই, কিন্তু আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। রাত ন’টা নাগাদ ঝেপে এলো মুসলধারায় বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। বালুঝড়। শয়তান সিং এর পরামর্শ মতো আমরা সবাই বেদুইনদের মতো করে চোখ, নাক, মুখ কাপড়ে পেঁচিয়ে নিয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অবশেষে বৃষ্টি থামার পরে ‘বুফে’ সিস্টেমে খাবার সাজানো হলো। ঘি দিয়ে গরম বাজরার রুটি, মরুভূমির কাঁটাঝোপ ফনিমনষা গাছের তরকারির সঙ্গে মিষ্টি। ফনিমনষা গাছের তরকারি যে এতটা সুস্বাদু হতে পারে ধারনা ছিলনা। রাতের খাবারের পরে আমরা গেলাম মরুভূমিতে নাইট সাফারি করতে।
রাতের মরুভুমিতে হরিনের ছড়াছড়ি। জানতাম বলিউডের ছবির শুটিং করতে এসে মরুভূমিতে কৃষ্ণসার হরিন শিকার করে কয়েকজন নায়ক নায়িকা কি বিপাকে পরেছিলেন ! জিপগাড়ির হেডলাইটের আলো গিয়ে পড়ছে মরুভুমিতে ঘাষ খেতে আসা হরিনের গায়ে। সেই আলোতে ছুটন্ত হরিনকে ধাওয়া করছে জিপগাড়ি।
একটি জিপগাড়িতে আমি আর আমার মেয়ে ছাড়া কেউ নেই। মরুভূমির উঁচু-নীচু বালিয়াড়ি দিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে আমাদের জিপগাড়ি। উদ্দেশ্য হরিনকে যতক্ষন সম্ভব আমাদের দেখানো। গাড়ির চালক তাঁর দায়িত্ব পালনে কমতি করছেন না। কিন্তু হরিনকে তাড়া করতে যাওয়া জিপগাড়ির ঝাঁকুনিতে আমাদের দু-জনের শরীর থেকে প্রায় হাড়হাড্ডি খুলে যাওয়ার অবস্থা।
সেরাতে মরুভূমির তাঁবুতে ভালো ঘুমিয়ে সকালে উঠে দেখলাম, গত রাতের অতিথিরা সবাই জয়সলমীরে ফিরে গিয়েছেন। মরুভূমিকে ভালোভাবে উপভোগ করবো বলে দুরাত সেখানে থাকার সিধান্ত নিয়েছিলাম। দুপুরে আড্ডা মেরে কাটালাম স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে। তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে খোঁজ নিলাম নিছকই কৌতুহলে।
বিকেলে টেন্টে এসে হাজির হলেন চারজনের এক সুইডিস পরিবার। বাবা-মা-মেয়ে-জামাই। যথেষ্ট আন্তরিক তাঁরা। বিকালে আবার উটে চড়ে সূর্যাস্ত দেখে এসে জমিয়ে আড্ডা মারলাম সুইডিস পরিবারের সঙ্গে। সুইডিস মেয়েটি আবার আমার মেয়ের বয়সী। কাজেই ভাব জমতে সময় লাগলো না।
রাতে আবার স্থানীয় শিল্পীদের নাচ-গান। সেদিন সুইডিস পরিবারটিকে সঙ্গে নিয়ে যে রাজস্থানী মহিলা নাচ দেখাতে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে নাচলাম আমরা সবাই। সকালে জয়সলমীরে নিজের জিপে চাপিয়ে আমাদের তিনজনকে পৌঁছে দিয়ে গেল শয়তান সিং নিজেই। তাঁবু থেকে বের হওয়ার আগে সেই সকালেই শয়তান সিং একটা পানীয় হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। শয়তান সিং এর সঙ্গে এখনও মাঝেমাঝে দিওয়ালি বা নিউ ইয়ারে টেলিফোনে কথা হয়। সে মনে রেখেছে আমাকে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584