সুশোভন পাত্র
জাস্ট একবার ভাবুন। বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী। বুদ্ধবাবু ফি-বছরে ২লক্ষ চাকরি দেবেন বলে স্বপ্ন দেখান। সরকারী পয়সায় ‘বেঙ্গল মিন্স বিজনেস’র আসর বসান। অমুক লগ্নি, তুমুক বিনিয়োগের গল্প শোনান। শিল্প ধরতে বিদেশ গিয়ে মিকি মাউসের পিয়ানো বাজান। অথচ, সেই বুদ্ধবাবুর নাকের ডগায় রাইটার্সে, বেকারির জ্বালায় গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করলেন সঞ্জয় সাহা। দুধের শিশু কোলে নিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী শর্মিষ্ঠা বলছেন, এলাকার প্রভাবশালীর সিপিএম নেতার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা প্রোমোটারের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করায় দুদিন আগেই হেনস্তা হতে হয়েছিল তাঁর স্বামী কে।
জাস্ট একবার ভাবুন। বুদ্ধবাবু গলার শিরা ফুলিয়ে ‘জঙ্গলমহল হাসছে’ বলে মঞ্চ কাঁপান। অলিতে গলিতে ২টাকা/কেজি চালের বাতেলা শোনান। সরকারী পয়সায় নিজের হোর্ডিং টাঙ্গিয়ে ফুটুনি মারান। আর পূর্ণাপানির শবররা অনাহারে-অপুষ্টি তে প্রিয়জন’দের লাশ কুড়ান। রেকর্ড ৩৪% বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা পঞ্চায়েতে লুটের রাজত্ব। ‘হার্মাদ’দের তোলাবাজি তে বন্ধ গ্রামের রেশন। অবশ্য মুখে ভাত না থাক, এলাকায় চোলাই মদের কোন অভাব রাখেন না সিপিএম নেতারা।
জাস্ট একবার ভাবুন, বুদ্ধবাবু বলছেন, ‘উৎসব করব না তো কি শ্রাদ্ধ করব?।’ বুদ্ধবাবু শবরদের গ্রামের বাইরে খাকি পোশাকের পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছেন। তাক লাগানো মেনুর সম্ভারে আহারে বাংলায় অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। হেলিকপ্টারে উড়ে জগদ্ধাত্রী পূজার উদ্বোধন করছেন। বুদ্ধবাবু ফিরে এসে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ক্যাডার মিটিং-এ দিল্লি জয়ের ডাক দিচ্ছেন।
বুদ্ধবাবু-সিপিএম-আত্মহত্যা-চোলাই-অনাহার-হেলিকপ্টারর-পুলিশ। জমকালো স্টোরি লাইন না? ব্রেকিং নিউজে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ সাজানো প্লেট। প্লেটের উপর বামফ্রন্ট সরকার কে কচুকাটা করে সাজানো ডিশ। আর মুখ্যমন্ত্রীর ঔদ্ধত্য তো ‘আইস অন দি কেক’। শর্মিষ্ঠা সাহা কে স্টুডিও তে বসিয়ে এক্সক্লুসিভ ইন্টার্ভিউ হবে। শবরের শব সাজিয়ে সিক্সটি পয়েন্টের হেডিং হবে। অনাহারদীর্ণ জঙ্গলমহল আর আহারে বাংলা -পাশাপাশি রেখে ভিসুয়াল হবে। বুদ্ধিজীবীরা ঘণ্টাখানেকে সিপিএম’র বাপ-বাপান্ত উদ্ধার করে দেবে। জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী প্রতিদিন সকালে পাঁচ জন সিপিএম’র লাশ দেখতে চেয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলে দেবে। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন, দুধ জমে ক্ষীর হয়ে যাবে।
কিন্তু কি আশ্চর্য, এসব কিছুই হল না। ৯৯-র সাইক্লোনে গল্পের গরু গাছে চড়ানো মিডিয়া জানতেই পারলো না, সঞ্জয় সাহা খোদ নবান্নের সামনে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করল। মাননীয়া ছাড়া কারও তাঁবেদারি না করা মিডিয়া দেখতেই পেল না, সাতটা লাশের বিনিময়ে শবরদের পাতে আজ ভাত জুটল। সেদিন জঙ্গলমহলে আতস কাঁচে ‘হার্মাদ ক্যাম্প’ খোঁজা মিডিয়া প্রশ্নই করল না যে রেশনহীন গ্রামে বে-আইনি চোলাই মদের ভাটি চলছিল কার অনুপ্রেরণায়? আর শবর’দের লাশ সাজিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হেলিকপ্টার চাপার আহ্লাদিপনা করেন কার বাপের পয়সায়? করল না কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর নামটা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নয়। গত ১৫দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো সিপিএম’র আমলে নয়। শাসক দলের সদর দপ্তর আলিমুদ্দিনে নয়। বরং কালীঘাটে। আর ঘটনা গুলো তৃণমূলের রাজত্বে। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুকুমতে।
রেজ্জাক মোল্লা তখন সিপিএম। “হেলে ধরতে পারেনা কেউটে ধরতে গেছে” মন্তব্য তখন হট কেক। ‘বাম বিদায়ের’ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে রেজ্জাক মোল্লার বিদ্রূপ কে দায়িত্ব নিয়ে বেডরুমে পৌঁছে দিয়েছিল মিডিয়া। আর আজকে সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক, পাঁচ বছর ক্যাবিনেটের সদস্য রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলছেন, “সিঙ্গুরে টাটারা কারখানা শুরু হলে সব কৃষকই জমি দিয়ে দিতেন। তাঁরা বুঝতেন এতে কাজ হবে, প্রশিক্ষণ মিলবে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই টাটারা পুরো জমিটাই পেয়ে যেতেন। আর এটা সরকারের বিরাট সাফল্য হতো। সিপিএম আরও বেশ কিছুদিন রাজ্যের সরকারে থাকতে পারতো।“ সেদিন রেজ্জাক মোল্লা কে বুদ্ধবাবুর “জনবিরোধী শিল্পনীতির” বিরুদ্ধে প্রক্সি-ওয়ারের ক্রুসেডর বানানো কোন মিডিয়ার হিম্মত আছে নাকি রবীন্দ্রনাথ বাবুর বিবৃতি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ছুঁড়ে মেরে সিঙ্গুরের ‘জমি আন্দোলনের’ ন্যাকামির কৈফিয়ত চাওয়ার? কোন মিডিয়ার হিম্মত আছে নাকি সিঙ্গুরের কৃষক’দের চাওয়া পাওয়ার সাচ্চা ময়নাতদন্ত করার? বাংলার বেকার’দের জীবন যন্ত্রণার আর্তনাদের প্রতিধ্বনি ছাপার?
নেই! কারণ এই গৃহপালিত মিডিয়াই তো সেদিন মমতা কে মসিহা বানিয়েছিল। চ্যাংড়া তৃণমূল কে ‘কৃষক দরদী’ সাজিয়ে পাড়া মাথায় তুলেছিল। ‘পরিবর্তন চাই’ বলে কাঁদুনি গেয়েছিল। আর এই গৃহপালিত মিডিয়াই সেদিন আপনাকে “৩৪ বছরে কিছুই হয়নি” বলতে শিখিয়েছিল।
১৯৯৮-২০১০, রাজ্যে প্রতি বছর এস.এস.সি’র মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছিল ১,৮৫,৮৪৫ জন। পেটো মস্তানদের ৮-১০লক্ষ ঘুষ দিতে হয়নি। হাইকোর্টের কাছে বারবার মুখ ঝামা খেতে হয়নি। ২০০৪-২০১০, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাধের ‘গুজরাট মডেল’ কে টেক্কা দিয়ে সেরা হয়েছিল বাংলা। সরকারী পয়সায় মুখ্যমন্ত্রী কে বিদেশ সফরে যেতে হয়নি। ‘বেঙ্গল মিন্স বিজনেস’র আদিখ্যেতা করতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বাংলার মন্ত্রী-মেয়র’দের ক্যামেরার সামনে ঘুষ খেতে হয়নি। সাংসদ’দের চিট-ফান্ডের চিটিং বাজির জন্য জেলে যেতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী’দের ১.৮৬ কোটির ছবি বিক্রি করতে হয়নি। ডেলোতে সুদীপ্ত সেন’দের সাথে গভীর রাতে বৈঠক করতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, দলের চোর-লম্পট’দের আড়াল করতে সিবিআই তদন্তে বাধা দিতে হয়নি। বিজেপির সাথে সেটিং করে সিবিআই’র জুজুতে রাফালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, ১লক্ষ সরকারী শূন্যপদে নিয়োগ বাকি রেখে সরকার মোচ্ছবে মাতেনি। মহার্ঘ্য ভাতা বকেয়া রেখে ক্লাবে ক্লাবে গুণ্ডা পুষতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বাংলার রাজনীতি তে ধর্মের নামে ভোট চাইতে হয়নি, জীবন-জীবিকার সমস্যা কে আড়াল করে রথের চাকায় সাম্প্রদায়িকতার বারুদ সাজাতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বুদ্ধিজীবী’দের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে সরীসৃপ সাজতে হয়নি। মিডিয়া কে এই নজিরবিহীন নির্লজ্জ স্তাবকতা করতে হয়নি। সীমাহীন ঔদ্ধত্য কে ‘সততার প্রতীক’ বলে চালাতে হয়নি।
সত্যিই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ঠিকই বলেন, ৩৪ বছরে তো কিছুই হয়নি। গৃহপালিত মিডিয়া তো ঠিকই বলে ৩৪ বছরে তো কিছুই হয়নি। জাস্ট একবার ভাবুন তো, ৩৪ বছরে তো কত কিছুই হয়নি।
(নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত নিবন্ধ কারের একান্তই ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুনঃ সব মরণ নয় সমান
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584