ফিরে দেখাঃ বিমুদ্রায়ণ ও ভারতীয় অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থা
‘কালো টাকা বিরোধী দিবস’- এর “ঘুটঘুটে কালো” দিকের অনুসন্ধান
-উদ্দালক তথাগত বিন্ধানী
৮ই নভেম্বর, ২০১৬… মধ্যরাতে দেশ বিমুদ্রায়ণের ঝাঁকুনি খেলো; চলতি ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট, যা ছিল দেশের বাজারে সরবরাহ হওয়া মুদ্রার ৮৬%, তা সেই মুহূর্ত থেকে বাতিল হয়ে যায়। কালো টাকা এবং তৎসম্পর্কিত সন্ত্রাসবাদকে অর্থসাহায্য ও জাল টাকার সরবরাহ দমন করার উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার হিসেবে এই পদক্ষেপকে তুলে ধরে কেন্দ্রীয় সরকার। এর ফলে দেশজুড়ে বইতে থাকে ভয় ও সন্দেহের তরঙ্গ; সাধারণ মানুষ, আমলা ও অর্থনীতিবিদ, প্রত্যেকেই এই পদক্ষেপের পরিণতি সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠে। ১৯৪৬ ও ১৯৭৮-এর ব্যর্থ পদক্ষেপগুলির পর তৃতীয়বার দেশ কি ভাগ্যবান হবে? এই প্রশ্ন জনমানসে ছড়িয়ে পড়ে। এর উত্তর পাওয়া তখনও বাকি ছিল। কিন্তু এর উত্তর খুঁজতে যখন দেশের মানুষ নিজেদের ও বাইরের দেশগুলির ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হয়, সমাজের প্রধান অংশ শ্রমিকরা এই পদক্ষেপের পরে কিভাবে প্রভাবিত হবে সেই সম্পর্কে আলোচনা থেকে বিরত থাকে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ধারক ও বাহকরা।
এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্গালোরের ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স’-এর ক্যাম্পাস চত্বরে একটি সমীক্ষা করা হয় যার থেকে উঠে আসে সেখানকার কন্সট্রাকশান সাইটগুলিতে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনে বিমুদ্রায়ণের ফলে উদ্ভূত দুর্দশা।
এই শ্রমিকদের একটা বড় অংশ দেশের উত্তরদিকের রাজ্য যেমন পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে আগত; বাকিরা এসেছিল কর্ণাটকের বিভিন্ন জেলা থেকে।
অর্থনৈতিকভাবে সমাজচ্যুত এই অংশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও সঞ্চিত অর্থের অভাব বহুল প্রচারিত ‘প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনা’-র সাফল্যের পরিপন্থী। বিমুদ্রায়ণের ফলে খুব জোর ধাক্কা খায় তারা, তাদের ৫০০ ও ১০০০ টাকায় গচ্ছিত স্বল্প সঞ্চয় রাতারাতি তার প্রয়োজনীয়তা হারায়। আঞ্চলিক মহাজনরা হাঙরের মত রঙ্গমঞ্চে ঝাপিয়ে পড়ে প্রতিটি পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকা পিছু যথাক্রমে ১০০ ও ২০০ টাকার কমিশান নিতে থাকে নতুন নোট বিলি করার সময়। এই অভিবাসী শ্রমিকদের আরেকটা অসুবিধা ছিল তাদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ব্যবধান। কম মূল্যের টাকার অভাবের ফলে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনতে অসুবিধা হতে থাকে। ফলে তারা একবেলা না খেয়ে আরেকবেলা শুধু মুড়ি খেয়ে নিজেদের সঞ্চয় রক্ষা করতে বাধ্য হয়। অভিবাসী হওয়ার দরুন অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের কাছে অপরিচিত হওয়ায় তারা টাকা ধার করতেও অসমর্থ হয়।
কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে থাকা নিজেদের পরিবারকেও তারা আর্থিক সাহায্য করতে পারেনি। এমনকি জাতিবিদ্বেষ ও ভাষাগত পার্থক্যের ফলে কন্নড় ভাষাভাষীরা তাদের কন্ট্র্যাক্টরদের থেকে নতুন নোট পেলেও বাকিরা মজুরী হিসেবে পুরনো নোটই পেতে থাকে।
কিন্তু এত কষ্ট সহ্য করেও তাদের মধ্যে একটি বিষয়ে মতৈক্য দেখা যায়। তারা মনে করে যে তাদের এই ‘সাময়িক কষ্ট’ দেশের ‘উন্নতি’-তে সাহায্য করবে এবং ‘অপরাধী’-দের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রদান করতে সাহায্য করবে।
এই এক বছরে আমাদের অভিজ্ঞতা এটাই বুঝিয়েছে যে এই প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছিল বাজারে সরবরাহ হওয়া নোটের সংখ্যা কমিয়ে জাতীয় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের আসল উদ্দেশ্য কালো টাকা নিয়ন্ত্রণ নয় বরং আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির লাভের অঙ্ক বজায় রাখা। ফলে কেন্দ্রের ‘কালো টাকা বিরোধী দিবস’ উদযাপনের এই মুহূর্তে একটি প্রবাদ মনে পড়ছে, ‘কুমীর শিকার করতে পুকুর শোকানো হল। কোনও কুমীর পাওয়া গেল না কারণ পুকুরে কুমীর থাকে না। কিন্তু ছোট মাছগুলি মারা গেল!’।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
একতা গুপ্তা, সুব্রত দে, সূর্য শঙ্কর সেন, বিজয়শ্রী সি. এস. এবং ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স’, ব্যাঙ্গালোর।
(লেখক:-উদ্দালক তথাগত বিন্ধানী ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ আডভান্সড স্টাডিজ’, ব্যাঙ্গালোরে ব্যবহারিক বাস্তুবিদ্যায় গবেষণারত এবং ‘চলিত কুয়াশা’ পত্রিকা সংগঠনের সদস্য।)
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584