মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার সামাজিক চেতনার ধারা

    0
    156

    ড. তাপস বন্দ্যোপাধায়:গঙ্গা বা ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়কে রাঢ় বলা হয়। অন্যদিকে ভাগীরথীর পূর্ব পাড়কে বাগড়ি বলা হয়। রাঢ় অঞ্চলের সীমা দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। এই দীর্ঘাকার রাঢ় অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে অজয়ের ধারার মাধ্যমে। অজয় নদের উত্তর অংশকে উত্তর রাঢ় বলা হয়। মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমা উত্তর রাঢ়ের অন্তর্গত। এই মহকুমার মাঝখান দিয়ে পূর্ববাহিনী হয়ে ভাগীরথী পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে ময়ুরাক্ষী। গত শতকে কান্দি মহকুমার পশ্চিমে অবস্থিত বীরভূম জেলায় পাণ্ডুরাজার ঢিবি খননের পর প্রমাণিত হয়েছে যে — এই রাঢ় এলাকার সভ্যতা প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রাচীন। সেই সভ্যতার ধারা কান্দি মহকুমা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল কিনা, তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে অনুমান করা যায় যে বুদ্ধের জন্মের আগে এই এলাকায় বেশ উন্নত সভ্যতা ছিল।


    মহাবীর ও বুদ্ধের জন্মের আগে রাঢ়ভূমিতে বৈদিক আচারের সূচনা ও প্রসার ঘটেছিল। বৈদিক যজ্ঞ, আচার, পশুবলি, ব্রহ্মণ্যবাদের প্রতিস্পর্ধিতায় শ্রমণ আন্দোলন হয়েছিল এখানে। এই পর্বে মোখ্‌খলি গোশাল, অজিত কেশকম্বল প্রমুখের নেতৃত্বে বৈদিক যজ্ঞের বিরুদ্ধে লোকসাধারণকে সংযুক্ত, উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। এর পরের পর্বে এই রাঢ় এলাকায় এসেছিলেন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ। তিনি বজ্রভূমি ও সুহ্মভূমি পরিভ্রমণ করেছিলেন। সুহ্মভূমির মধ্যে তিনি প্রাচীন সিংহপুরে কয়েক বছর অবস্থান করেছিলেন। এই প্রাচীন সিংহপুর মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার মধ্যে অবস্থিত। ময়ুরাক্ষী নদীর তীরে গঙ্গার সন্নিকটে এই সিংহপুর সমৃদ্ধ নগরী ছিল সেই সময়েই। এখানে লঙ্কাজয়ী বিজয় সিংহের ভাই সুমিত্র রাজা হয়েছিলেন এবং এই সিংহপুরে তার রাজধানী ছিল। এই সিংহপুর কান্দি মহকুমার মধ্যে অবস্থিত গড্ডা সিংহারি গ্রাম বলে মনে হয়।
    বৈদিক যাগযজ্ঞের পাশাপাশি এই এলাকায় জৈন ধর্মের প্রসার ঘটেছিল এই এলাকায়। তার কিছুটা পরে কুষাণ যুগ থেকেই এই এলাকায় বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটতে থাকে। হুয়ান চাং যখন কর্ণসুবর্ণে এসেছিলেন তখন তিনি এখানে ‘মৃগশিখাবন’ নামক একটি বৌদ্ধবিহার দেখেছিলেন। এই বিহার রক্তমৃত্তিকা নামক নগরীতে অবস্থিত ছিল। তিনি এই এলাকায় তিনটি বৌদ্ধ সংঘারাম ও বারোটি বৌদ্ধ মঠ দেখেছিলেন। পাশাপাশি তিনি দেখেছিলেন প্রায় পঞ্চাশটি হিন্দু মন্দির। পঞ্চম শতকে এই এলাকায় জৈনধর্মের প্রসার ঘটেছিল পাঁচথুপিকে কেন্দ্র করে। আবার সপ্তম শতকে এই এলাকায় বৌদ্ধধর্মের বিস্তার হয়েছিল রক্তমৃত্তিকা বা কর্ণসুবর্ণকে কেন্দ্র করে। পাশাপাশি এই এলাকায় বৈদিক দেবতা ও লোকদেবতা মিলে এক নতুন ধরনের হিন্দুধর্ম প্রচারিত হয়েছিল কুষাণ যুগ থেকে।
    এই এলাকায় জৈনধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম বিভিন্নরকমভাবে মিশ্রিত হয়েছে পালযুগে। এর সঙ্গে মিশেছে গণসাধারণের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্নরকম লোকধর্মের রীতি ও আচার। বৈদিক আচার ও প্রতিবৈদিক আচার মিলেমিশে এক নতুন ধরনের সংমিশ্রিত লোকাচারের দেখা পাওয়া যায় মুর্শিদবাদের এই এলাকায়। ধর্মকে কেন্দ্র করে সামাজিক রীতি, পারিবারিক আচার, ভাষা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে সমগ্র বঙ্গদেশে। এই এলাকা তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে লোকসাধারণের আনাগোনার ফলে সামাজিক জীবনাচরণ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রবল বিমিশ্রণ দেখা যায় এখানে।
    দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এই এলাকায় পুনরায় হিন্দু ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকে। জৈনধর্ম অনেক ক্ষেত্রে হিন্দুধর্মের সঙ্গে মিশে যায়। বৌদ্ধধর্ম কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিন্দুদর্শনের সঙ্গে আপোষ করে নেয়। ফলে মুর্শিদাবাদ জেলার এই কান্দি মহকুমায় তুর্কি আক্রমণের আগে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মকে কেন্দ্র করে এক মিশ্রিত সমাজ গড়ে ওঠে। তুর্কি আক্রমণের অব্যবহিত পরে এই এলাকায় বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা যায়। তুর্কি শাসকেরাও স্থানীয় প্রজাদের সঙ্গে সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে পারে নি প্রায় দেড়শো বছর। এর পরের পর্বে আরব, ইরাণ, আফগানিস্তান থেকে সেখ, সৈয়দ, পাঠানরা এই এলাকায় বসতি স্থাপন করতে থাকে। একাধিক পীর, দরবেশ, সুফি সাধকেরা ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির বার্তা বহন করে নিয়ে আসে। ফলে এই এলাকায় নবাগত ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে। পঞ্চদশ শতক থেকে এই এলাকায় হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের মিশ্রণ ঘটতে থাকে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পরে বঙ্গদেশে ভক্তিবাদ প্রায় সবক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ইসলাম ধর্মেও সেই গুরুবাদ অনুপ্রবেশ করে। এর ফলে মুসলিম সমাজে প্রসারিত হয় পীর-সংস্কৃতি। এরপর থেকে ভক্তিবাদী হিন্দুরা যেমন ইসলাম ধর্মের কাছে বিভিন্ন সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে, তেমনই ইসলাম ধর্মেও হিন্দু-বৌদ্ধদের বিভিন্ন রীতিনীতি প্রবেশ করেছে। ফলে এক বিচিত্র ধরনের মিশ্রতা এই এলাকায় জনচেতনার মধ্যে অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে।
    আজকের বাঙালী সংস্কৃতির মূল ধর্ম হলো মিশ্রতা। বাঙালী নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম, ধর্মকেন্দ্রিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুসারী নয় এখনও। যুগে যুগে বিভিন্ন কৃষ্টিকে সে আত্মসাৎ করেছে। বাঙালীর প্রথম পরিচয় – সে বাঙালী ; পরে সে তার কোনো না কোনো ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করে। ইতিহাসের আদিপর্বে এই এলাকার লোকধর্মের সঙ্গে বৈদিক সংস্কৃতি মিশ্রিত হয়েছিল। সেই সময়ে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত হয়েছিল শ্রমণ-জৈন ধর্ম ও সংস্কৃতি। এর পরের পর্বে বৌদ্ধধর্ম রাজানুগ্রহ লাভের পরে এই এলাকায় প্রসারিত হলো, সেই সময়ে পূর্বের মিশ্রণে সেই ধর্ম ও সংস্কৃতি যুক্ত হয়েছিলো। বাংলা ভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতি মূলত মিশ্র সংস্কৃতির ফল। মিশ্রণের পরম্পরার চিহ্ন পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অঞ্চলের এই এলাকাতেও ; এখানকার জীবনাদর্শে ও সাহিত্যে। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে এই এলাকা। তখনও সেই সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে বাঙালী। এখনও পর্যন্ত সেই মিশ্রণ অব্যাহত আছে। বাংলা সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে সেই মিশ্রতার ধারাবাহিকতা এখনও প্রবহমান। বাঙালী সর্বপ্রথম বাঙালী ; পরে তার ধর্মপরিচয় প্রকাশিত হয়। কান্দি মহকুমার জনসাধারণ সম্বন্ধেও এই কথা প্রযোজ্য। শারীরিক গঠনে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে, লোকবিশ্বাসে, চালচলনে এই এলাকার মানুষ আগে বাঙালী, পরে তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত পরিচয় বিধৃত হয়। আজকের এই শতকের কালবেলায় কারা যেন এই বিমিশ্রিত বাঙালী সত্তাকে পিছনে ঠেলে ধর্ম পরিচয়ে অপস্থাপন করতে চাইছে। আগেও বিভিন্ন সময়ে এই ধর্মপরিচয়কে মুখ্য করে কেউ কেউ সুবিধা ভোগ করতে চেয়েছে। কিন্তু আশার বিষয় – বাঙালী সেই অপচেষ্টাকে উপেক্ষা করে ধর্মপরিচয়কে গৌণ করে নিজের বাঙালী সত্তাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। আজকের এই কালবেলায় অপচেষ্টাকারীদের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ হবে। অন্যান্য এলাকার মত এই কান্দি এলাকার মানুষ বাঙালী হিসেবেই পরিচিত থাকবে চিরকাল।

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here