অতি সম্প্রতি (২০১৭) তাজমহল নিয়ে
আবার জলঘোলা শুরু হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা
দাবি করতে শুরু করেছেন যে, তাজমহল হল আসলে একটি হিন্দুমন্দির। আর সেই
মন্দির ভেঙেই তৈরি হয়েছে তাজ। সুতরাং,
এটিকে বাবরি মসজিদের পরিণতির দিকে নিয়ে চলো। তাজমহল সম্পর্ক এই দাবি কিন্তু আজকের নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই এই
দাবি উঠেছিল আর.এস.এস-এর মুখপত্র
অর্গানাইজার পত্রিকায় তাজমহলকে রাজা মানসিংহের তৈরি হিন্দু মন্দির বলে লেখা প্রকাশিত হয়। এই প্রবণতাটিই একবিংশ শতাব্দীতে আরও ব্যাপক ভাবে প্রকাশ লাভ করে হিন্দুত্ববাদীদের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। তাজমহল হিন্দু রাজার তৈরি মন্দির — এই
দাবিতে পুরুষোত্তম নাগেশ ওক সুপ্রীম কোর্টে একটি মামলা করেন। ২০০০ সালের জুলাই মাসে সুপ্রীম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তা বাতিল
করে দেয়। বিচারপতিদের সমালোচনার মুখে আবেদনকারীর উকিল পিটিশনটি প্রত্যাহার
করে নেয়। ২০০৫ সালে এই একই দাবিতে
হিন্দুত্ববাদীরা এলাহাবাদ হাইকোর্টে একটি
মামলা করে। সুপ্রীম কোর্টের মতোই এলাহাবাদ হাইকোর্টেও সেটা বাতিল করে দেয়। তৎসত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার
চলতেই থাকে। থামে না।
হালে হিন্দুত্ববাদীদের মিথ্যা প্রচারে রসদ জুগিয়েছে পুরুষোত্তম নাগেশ ওক
নামে জনৈক ‘ঐতিহাসিক’। তাঁর তাজমহল সংক্রান্ত একটি বই ও একটি পুস্তিকা
প্রকাশিত হয়েছে — The Taj Mahal is Temple Place এবং Taj Mahal: The
True Story বই-এর নামের মধ্যেই রয়েছে তাঁর মূল বক্তব্যটি কী। হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারে ওক কে একজন অধ্যপক ও ঐতিহাসিক
হিসেবে দাবী করা হয়েছে। প্রশ্ন হল কে এই পি. এন. ওক ? ঘটনা হল তিনি অধ্যপকও
নন আবার কোনও ঐতিহাসিকও নন। ওক
নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে বলেছেন
যে, তিনি আগ্রা থেকে এম. এ. ও বোম্বাই থেকে এল. এল. বি. পাশ করেছেন। তিনি
কোন বিষয়ে এম. এ. পাশ করেছেন — তার উল্লেখ তিনি করেননি। তাঁর কর্মস্থল ছিল
ভারত সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রক। পূর্বে উল্লিখিত লেখা দুটি ছাড়াও আরও কয়েকটি লেখা তাঁর প্রকাশিত হয়েছে। মুসলিম বিদ্বেষের পাশাপাশি খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পর্কেও উদ্ভট ভাবনা প্রচারে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা
দেখিয়েছেন। যেমন, তার একটি কাজের শিরোনাম হলো ‘Christianity is Chrisnnity’ বা খ্রিশ্চানিটি হল কৃষ্ণ বা কৃষ্ণের নীতি। সম্ভবত সবচেয়ে হাস্যকর গ্রন্থ হল’‘হাস্যস্পদ আংরেজিভাষা’’ (Hasyaspada Angriji Bhasha)। কথা হল ইংরাজি ভাষা যদি হাস্যস্পদই হয় তাহলে তিনি ইংরাজি ভাষায় বই প্রকাশ করলেন কেন ? কথা হলো
কয়েকটি বই লিখলেই কাউকে ঐতিহাসিক
বলা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ও
উচ্চ মানের গবেষণা। এদুটির একটিও ওকের ঝুলিতে নেই। আর তা নেই বলেই তিনি
হিন্দুত্ববাদীদের ‘‘সার্থক ঐতিহাসিক’’-এ পরিণত হতে পেরেছেন।পি. এন. ওক ও হিন্দুত্ববাদীদের বক্তব্য
হল — তাজমহল আদতে হিন্দুদের শিবমন্দির
ছিলো এবং রাজপুত রাজার প্রাসাদ। এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন রাজা জয় সিং।
পরবর্তীকালে শাহজাহান এই প্রাসাদটি দখল করে নেন গায়ের জোরে। প্রাসাদটির নাম ছিল তেজো মহালয়া। যেটাকেই শাহজাহান
পরিবর্তিত করে তাজমহল করেনিয়েছিলেন। এটি কোনো সমাধি বা স্মৃতি মন্দির নয়,
মহল কথাটির অর্থ হল রাজকীয় প্রাসাদ। ওক
এই মত প্রকাশ করেছেন যে, তাজ মহলের বন্ধ ঘরগুলির মধ্যে অনুসন্ধান চালালে শিবের লিঙ্গ বা অন্যান্য প্রমাণ পাওয়া যাবে।এখানেই তিনি থামেন না, তাঁর আরও
দাবি হল তাঁর এই ‘তাজমহল’ থিওরি পৃথিবীর বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা নাকি মেনে
নিয়েছেন। তাজমহল সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরও নানা কথা বলেছেন পি. এন. ওক। তিনি
পুরাণের উল্লেখ করে বলেছেন, তাজমহল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে পূর্বে অগ্রেশ্বর শিবের মন্দির ছিল। শিব-এর নাকি এতই
ভালো লেগেছিল স্থানটি যে তিনি আর কৈলাসে ফেরত যেতে চাননি। আরও
বলা হয়েছে যে, দ্বাদশ শতাব্দীর পারমার দেব ১১৯৬ খ্রিষ্টাব্দে এই স্থানে একটি শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। আবার এও বলা হয়েছে যে, এখানে জাঠ সম্প্রদায়ের দেবতা ‘তেজজি’র মন্দির ছিল, যার নামেই এর নাম
হয়েছিল ‘তেজো মহালয়া’।
ওকের এই অদ্ভূত দাবিগুলির বস্তুনিষ্ঠ- ঐতিহাসিক বিচার প্রয়োজন। প্রথমত, ওক শব্দ নিয়ে খেলা করেছেন।
তিনি সংস্কৃত ও সংস্কৃত নয় এমন শব্দের মধ্যেকার বাহ্যিক ও অকিঞ্চিৎকর সাদৃশ্য উল্লেখ করে অদ্ভুত অদ্ভুত সিদ্ধান্তে এসেছেন।
যেমন ভ্যাটিক্যানের উৎস খুঁজে পেয়েছেন ‘ভাটিকা’ (মঠ বা সন্ন্যাসীর আশ্রম বা সাধনার ক্ষেত্রে) নামক সংস্কৃত শব্দের মধ্যে।
তাঁর কাছে ইসলাম হল ইশালয়ম (ভগবানের
মন্দির), আব্রাহাম হল ‘ব্রহ্মা’র অপভ্রংশ এবং জর্জ হল গর্গ। এবং একইভাবে তাজমহল
এসেছে তেজো মহালয়া’ থেকে। দুটি কথা বলাই এখানে যথেষ্ট হবে কোনও শব্দের উৎস খোঁজার জন্য যে গভীর ভাষা-তাত্ত্বিক
পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন- এখানে তা ভীষণভাবে অনুপস্থিত। দ্বিতীয়, ঐতিহাসিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তথ্যসূত্র নির্দেশ করা। ওক-এর লেখায় ওসবের বালাই নেই । তার
উদ্দেশ্য একটাই, যেন তেন প্রকারে মুসলিম শাসকদের হতমান করে হিন্দু-বিদ্বেষী
হিসেবে দেখানো। দ্বিতীয়, ওক ও হিন্দুত্ববাদীদের কল্পনাশক্তি এতটাই শক্তিশালী যে গল্পের
গরুকে সহজেই গাছে তুলতে পারেন। ওক-এর দাবি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সকল ঐতিহাসিক স্থপত্যই মূলগতভাবে
হিন্দু উৎসের সাথে যুক্ত। হমায়ুন, আকবরের সমাধি সহ ইতমাদুল্লা শুধু নয় ভ্যাটিকান সিটি, কাবা এবং স্টোনহেঞ্জ-এর উৎস হিন্দু
সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
এই দাবি থেকে বোঝা যায় ইনি না বোঝেন স্থাপত্যবিদ্যা, না বোঝেন ইতিহাস। তাঁর লেখার অন্যতম লক্ষ্য হল হিন্দুমনে অতীত সম্পর্কেমিথ্যে গর্ববোধ গড়ে তোলা। তৃতীয়ত, ওক-এর দাবি তাজমহলের বন্ধ ঘরগুলিতে শিবলিঙ্গ ও অন্যান্য প্রমাণ লুকোনো আছে। এই দাবির মধ্য দিয়ে তিনি তাজমহল সম্বন্ধে একটি রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছেন। এবং মুসলিম বিদ্বেষকে উসকে দিতে চেয়েছেন। সত্যিই কি
এই ধরনের কিছু তাজমহলের মধ্যে আছে? আছে কি কোন মন্দিরের অস্তিত্বের প্রমাণ ?
পুরাতত্ত্বের এক ছাত্র, যিনি ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজির ছাত্র, তাজমহল নিয়ে গবেষণা
করছেন এবং স্বচক্ষে দেখে এসেছেন বন্ধ ঘরগুলির অভ্যন্তর ভাগ। তার নাম সৌরভ ব্যানার্জী(Batch – 2014 – 16, Roll no.
141601)। তিনি একটি পোস্ট করেছেন এ সম্পর্কে। পড়া যাক তাঁর পোস্টটি:
‘‘কয়েক দিন ধরে (সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বের, ২০১৭) তাজমহল নিয়ে চর্চা হচ্ছে
এবং তাঁর দরজা খোলা নিয়ে, না নিয়ে–তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আর সর্বোপরি সত্য না জেনে খবরের কাগজগুলিতেও ছাপা হচ্ছে
তাতে এমন মনে হচ্ছে যেন তাজমহলের দরজার নীচে কোনও আজব জিনিস আছে বা মন্দির আছে।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী নীচে রয়েছে শাহাজাহান ও মুমতাজের
আসল সমাধি। আর কিছুই নেই। কারণ আমি নিজে সে জায়গায় প্রবেশ করেছি এবং দেখেছি, চড়েছি তাজ মহলের ছাদেও (২০১৬-এর আগষ্ট মাসে)। এটাকোনও কল্প কাহিনীর ব্যাপারই নয়।
আমি নিজে A S I-এর Institute of Archeology-র ছাত্র। যার অবস্থান Delhi–র Red Fort-এর ভেতরে। ফলে আমাকে লাল কেল্লায় দু বছর থাকতে হয়েছে। এই দু বছরে আমাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় পুরাতত্ত্বের ওপর। ফলে সেই সুবাদে শুধু তাজমহলে প্রবেশই নয়, আমার ভাগ্যে
জুটেছে অনেক অজানা জিনিস দেখার সুযোগ
যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভবই নয়। যেমন কোনারক মন্দিরের গর্ভগৃহ, অজন্তার
বিশেষ চিত্রকলা, গোল গম্বুজের অভ্যন্তর,
চারমিনারের ছাদ এছাড়া আরও নানান জায়গা। জানতে হয়েছে অনেক গুপ্তকথা যা বাইরে বলা যায় না। কিন্তু তাজমহলের এই বন্ধ দরজার নীচে শাহাজাহান, মুমতাজের আসল সমাধি ছাড়া আর কিছু নেই। তার এই দরজা বন্ধ রাখা হয় রহস্য করার জন্য নয়। সিঁড়ি অত্যন্ত সংকীর্ন বলে। এর ভেতরে কোনও রকমের মন্দিরের
অবশেষ নেই। মূর্তিও নেই। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার এ রকম সমাধি শুধু তাজমহলেই আছে তা নয়। মূলত এটি ইসলামিক স্থাপত্যের একটি বিশেষ অংশ যা আপনি
ভারতের অন্যান্য ইসলামিক স্থাপত্যেও দেখতে পাবেন। যেমন গোলগম্বুজ। মূলত
এক্ষেত্রে আসল সমাধি নীচে রাখা হয় আর ওপরের সমাধিটি হয় নকল। মধ্যযুগে রাজা বাদশাহদের সমাধিগুলো মূলত এভাবেই তৈরি করা হতো।ভারতের ইসলামিক স্থাপত্যের ইতিহাসেরও কয়েকটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায় অর্থাৎ ঘোরী যখন ভারত আক্রমণ করে তখন তারা মূলত হিন্দু, জৈন মন্দিরগুলো ভেঙে সেই উপকরণ দিয়েই তাদের স্থপত্য তৈরী করত। কারণ তারা এদেশের ভূগোল
সম্পর্কে অবহিত ছিল না। তারা জানত না যে মসজিদ তৈরির উরকরণ কোথায় পাবে। এছাড়া রাজনৈতিক কারণও থাকত। এরপর
যতই রাজত্ব এগিয়েছে ততই ইসলামী শাসকরা ভারতের ভূগোলের সাথে পরিচিত
হতে থাকে এবং মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ার কাজ তত কমে আসে। আর মোঘল যুগে এসে তারা মসজিদ ও স্থাপত্য নির্মাণের উপকরণ কোথায় পাওয়া যায় তার সম্পর্কে দক্ষ হয়ে যায়। ফলে তাদের আর মন্দির ভেঙে স্থাপত্য
গড়ার প্রয়োজনই ছিল না। তাই সেখানে শিবমন্দির থাকার ধারণাটাই ভুল। অন্যদিকে তাজমহলের স্থাপত্য সম্পূর্ণ আলাদা।
তো এই তাজমহলের অভ্যন্তরে ও ছাদে যেহেতু সাধারণ মানুষ যেতে পারে না – তারা নানান গল্প তৈরি করে তাজমহল নিয়ে। আর
সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার তখন হয় যখন তা রাজনীতির আবর্তেচলে আসে। যেহেতু Institute of Archeology–র ১৫ জন ছাত্র/ছাত্রী এবং A S I–এর উচ্চপর্যায়ের অফিসাররা ছাড়া আর বিশেষ কেউই তাজমহলের এই অংশগুলিতে প্রবেশ
করতে পারে না বা অনুমতি পায় না। তাই তা নিয়ে গল্প বানানো সহজ হয়ে যায়। (1 November, 2017, Whats App) পঞ্চমত, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের (১৮৮৮-১৯৮০) প্রতিক্রিয়াটি
খুবই চিত্তাকর্ষক। চিন্তার দিক থেকে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল এবং RSS–এর মুখপাত্র
অর্গানাইজার-এর প্রায় নিয়মিত লেখক। একবার এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যে, তাজমহল আসলে রাজা মানসিংহের নির্মিত হিন্দুমন্দির। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের কাছে এই লেখা যখন পৌঁছায়,
তিনি অত্যন্ত রেগে গিয়ে ঐ পত্রিকাকে লেখেন
Stop all that nonsence — অর্থহীন এইসব বন্ধ কর। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাকে
জানায় তাদের তো মত প্রকাশের স্বাধীনতা
আছে। এর উত্তরে মজুমদার বলেন, ‘তাহলেআমারও স্বাধীনতা আছে তোমাদের পত্রিকায় না লেখার।’ রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত The History and Culture of the In-
dian People (Vol-7)–এর সম্পাদকীয় ভূমিকায় তাজমহল সম্পর্কে বলেছেন, “The Mughal period should also be cred- ited with great artistic achievement whose extant remains far exceed in skill and grandeur those of any oth- er period in the history of India. A
risible embodiment of its brilliance is the Taj Mahal of Agra, which is justly regarded as one of the eight wonders of the world.” (Majumdar,
2007 : 7 : XV)
ঐ একই খণ্ডে ঐতিহাসিক এস. কে. সরস্বতী শাহাজাহানের শিল্পবোধ
ও স্থাপত্যকীর্তিকে প্রভূত প্রশংসা করেছেন। কোথাও তিনি হিন্দুত্ববাদীদের
মতো তাজমহলকে হিন্দুমন্দির বলে বর্ণনা
করেননি। তিনি লিখেছেন, “To enshrine the remains of his beloved Consort
he [Shah Jahan] raised up at Agra that grand mausoleum building, the
far-famed Taj Mahal, enthusiastically eulogized by many enamored visitors as a “dream in marble”. (Saraswati, S. K. 2007 : 7 : 783)। ষষ্ঠত, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার কোন কালেই মুসলিম শাসনকে ভালো চোখে দেখেননি। চিরকাল বরং তীব্র সমালোচনাই করে এসেছেন। তাঁর গ্রন্থ Studies in Mughal India-তে তাজমহল নির্মাণের একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। যে সব গ্রন্থ, রচনার ও দলিলের ভিত্তিতে তিনি তাঁর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলি হল — (ক) সপ্তদশ শতাব্দীর ফার্সি গ্রন্থ সমূহ, (খ) বিভিন্ন ভারতীয় ও ইউরোপীয় পর্যটকদের বিবরণ, তথ্য (গ) নানা ধরনের সরকারি দলিল। যদুনাথ সরকারের গ্রন্থ
থেকে তাজমহলের যে ইতিহাসটি পাই সেটি এইরকম : আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) পুত্র
জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭) তখন দিল্লীর সম্রাট। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র খুররম (পরে
শাহজাহান)-এর সঙ্গে মন্ত্রী আসফ খানের মেয়ে ও পত্নী নূরজাহানের ভাইঝি আর্জুমান্দবানু বেগমের বিয়ে হয় (১৬১২)। শাহজাহান
তখন ২০ এবং আর্জুমান্দ প্রায় উনিশ বছর। বিয়ের পর আর্জুমান্দের নতুন নাম হল
‘মমতাজ-মহল’ বা ‘প্রাসাদের আলো’। তাদের বিবাহিত জীবন ছিল ১৯ বছর।
তারপর মৃত্যু এল। প্রিয় মমতাজকে ছিনিয়ে
নিয়ে গেল শাহজাহানের কাছ থেকে। ১৬৩১-এ গহরআরার জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন মমতাজ। শাহজাহান তখন
দাক্ষিণাত্য অভিজানে বেরিয়েছিলেন। সঙ্গে
ছিলেন মমতাজ। তাঁকে বুরহানপুরে তাপ্তি নদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়।শাহজাহান
সিদ্ধান্ত নেন মমতাজের স্মৃতিতে আগ্রায় একটি সমাধি মন্দির তৈরি করবেন।আগ্রার
দক্ষিণে যমুনার তীরে অম্বররাজ জয়সিংহের
কাছ থেকে একটি বড় আয়তনের জমি কেনেন। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে তাজমহল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রাথমিক
কাজ চলার সময়েই মৃত্যুর ২০ মাস পরে মমতাজের দেহাবশেষ বুরহানপুর থেকে
আগ্রায় নিয়ে এসে সমাধিস্থ করা হয়। এই সমাধি সৌধ নির্মাণের পূর্বে শাহজাহান দেশের দক্ষ স্থপতিদের সাথে
পরামর্শ ও পরিকল্পনা করেন। দুজন দক্ষ স্থপতির উপর ভার দেওয়া হয়েছিল সমগ্র
কাজটির দেখাশোনা করার। তারা হলেন মুকাররামত খান ও মীর আব্দুল করিম।
প্রত্যেকটি কাজেই নিয়োগ করা হয় দক্ষ ব্যক্তিদের, যেমন, (ক) কান্দাহারের আমানত খান সিরাজি — ক্যালিগ্রাফি, (খ) উস্তাদ ঈশা
— প্রধান রং মিস্ত্রী, (গ) উস্তাদ পীরা — কাঠের কাজ, (ঘ) বানুহার, ঝাটমল ও জাবোরার — ভাস্কর্য, (ঙ) ইসমাইল খান রুমি — গম্বুজ
ও তার বহনকারী ঢোলা ও মাচান (scaffolding), (চ) রাম সাই কাথিরী — চারবাগ
উদ্যান নির্মাণ। দেশ বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল ২০ ধরনের পাথর। তাজমহলের
মূল নির্মাণের কাজ ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হলেও ১৬৪৮ অবধি চলে অতি সুক্ষ্ম শিল্প ও সৌন্দার্যায়নের কাজ।
মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকেই অনুপম সব স্থাপত্য তৈরি হতে শুরু হয়।
হুমায়ুন সৌধ, ফতেপুর সিকরি, আগ্রাফোর্ট,
সিকান্দারা (আকবরের সমাধি), লাহারো জাহাঙ্গীরের সমাধি, দিল্লীর লালকেল্লা ও
জুম্মা মসজিদ, আগ্রাফোর্ট ইত্যাদির মতো আরও বহু স্থাপত্যের নাম এখানে করা যেতে পারে। শেষ চারটি স্থাপত্য শাহজাহানের
তৈরি। তাঁর শাসনকালকে মুঘল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়। S. K. Saraswa-
ti শাহজাহানের সময়কার মুঘল স্থাপত্যের উৎকর্ষতার দিকে নজর রেখে বলেছেন, “It was during the time of Shah Jahan that Mughal architecture reaches its supremeexuberance.”(Saraswati 2007:7:780)।
পণ্ডিত জহরলাল নেহরু তাঁর The Discovery of India নামক গ্রন্থে ভারতীয়
সংস্কৃতিকে মিশ্র সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি,
সর্বক্ষেত্রেই এই সমন্বয়ের সন্ধান পেয়েছেন। ভারতের মিশ্র স্থাপত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: “A new architecture developed in India, a combination of Indian ideals and Persian inspiration and Delhi and Agra were covered
with noble and beautiful buildings of the most famous of these, The Taj Mahal, M. Grousset, the French savant, said that it is ‘the soul of Iran
incarnate in the body of India.’ (Nehru 2002:148)। ফলে মিশ্র স্থাপত্যের ফল
হিসেবে এটার কোনও কোনও দেশীয় বৈশিষ্ট্য থাকায় সেটা দেখে ওক-এর মত কষ্ট কল্পনা করার কোনও সুযোগ নেই বললেই চলে। কোনও ঐতিহাসিক তথ্যই ওক-এর
এইসব উদ্ভট ও আজগুবি দাবিকে সমর্থন করে না। তপন রায়চৌধুরী বলেছেন, ওক হলেন এমন একজন ‘ঐতিহাসিক’ যিনি সংঘ
পরিবারের কাছে শ্রদ্ধেয়। আরও একজন তাজমহল ও কন্দকাহিনী প্রতিথযশা ঐতিহাসিক কে. এন. পানিক্কর-এর মতে ওক ভারতীয় ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক বিকৃতি ঘটিয়েছেন। (উইকিপিডিয়া
17.11.2017) অর্থাৎ ইতিহাসতত্ত্ববিদগণের
কাছে সংঘ পরিবারের এই তাত্ত্বিক কল্কে পেলেন না। না ইতিহাসবিদ, না ঐতিহাসিক
তথ্য প্রমাণ-এর সমর্থন — কোনওটাই সংঘ পরিবার ও তাদের ‘ঐতিহাসিক’গণ জোগাড় করতে পারেন নি। তাদের হাতে তাই কিছুই
নেই, আছে শুধু বলপ্রয়োগ, মিথ্যা প্রচার এবং খ্যাতনামা ঐতিহাসিকদের রচনাকে
পাঠক্রমকে বাদ দেওয়া। যেমন, ঐতিহাসিক
রামশরণ শর্মা, সতীশ চন্দ্র, রোমিলা থাপার,
অর্জুন দেবের NCERT-র ষষ্ঠ, অষ্টম ও একাদশ শ্রেণির জন্য লেখা বইগুলির বিভিন্ন
অংশ BJP সরকার নির্বিচারে বাদ দিয়েছে। (দ্রষ্টব্য Mushirul Hassan 2008:246-52 in McGuire & Copland.ed.2008)। কারণ সেগুলি তাদের
নাপসন্দ। তথ্যপঞ্জী :
দত্তচৌধুরী, শান্তনু। ২০১৭, মার্চ। ‘‘এবার লক্ষ্য তাজমহল’’ / প্রকাশিত দিলীপ চক্রবর্তী(সম্পাদিত)। ২০১৭, মার্চ। সপ্তাহ। কলকাতা।
Nehru, Jawaharlal.2002. The Discovery of India./New Delhi: J N M
Fund.Majumdar, R. C. 2007. vol–7 . The
Mughal Empire (in the series of The History and Culture of the Indian
People). Mumbai: Bharatiya Vidya
Bhaban.Saraswati, S. K. 2007. “Mughul Architecture”. published in Majumdar . 2007, vol – 7 Hassan, Mushirul. 2008. “The BJP’s Intellectual Agenda”. published in McGuine and Copland
(ed). 2008. Hindu Nationalism and
Gorennarce. New Delhi : Oxford University Press.
উইকিপিডিয়া . 17. 11. 2017
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584