পিয়া গুপ্তা,লাভাঃ
কুয়াশা ও মেঘে ঢাকা পাইন গাছে ঘেরা কালিম্পং থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লাভা। উত্তর বঙ্গ ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন আমরা শিক্ষা মূলক ভ্রমনের উদেশ্যে চালসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যস্তল লাভার উদ্যেশ্যে।
পথে অপরূপ সৌন্দর্য সারি সারি মেঘ-চা বাগান আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি চলছিল।এরপর পথে পড়ল গরুবাথান। এক আধা পাহাড়ি,নেপালি জনপদ।গাড়ি থেকে তিস্তার শাখানদী চেল এর ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আমরা দেখতে থাকলাম।চেলের গর্জন,পাহাড়, ঝর্না প্রকৃতির সব রূপ একসঙ্গে মিশে সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। বাঁহাতি রাস্তায় চেল নদীর উপর কাঠের ব্রীজ পার হলাম।আমাদের গাড়ি এসে দাড়ালো চেল নদীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে।
চেল খোলায় নদীবক্ষে ছোট বড় অনেক প্রস্তরখন্ড।তার মধ্যে দিয়ে স্বশব্দে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদীটি।চারিপাশ সবুজ পাহাড়ে ঘেরা। সে দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করলাম সকলে।সেই অপরূপ সাজে সজ্জিত বয়ে চলা চেল পাশে ই আমরা কিছু সময় কাটালাম।যে যার মতো সেখানে নিজেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
ছবি তোলা শেষে সকলে নিজের নিজের মতো গাড়িতে বসে পরলাম।এরপর আমাদের গাড়ি দাড়ালো ঝান্ডি ইকো হান্ট।যেখানে দেখা যাবে
পাহাড় ও উপত্যকা জুড়ে অরণ্যের সৌন্দর্য। চারপাশে সবুজের কত রকম শেড।পাখির মেলা বসে চেনা অচেনাবহু পাখি।দু’ধারে ঘন চা বাগান, দূরে নীল নীল পাহাড়,কুয়াশা মাখা মিঠে রোদ্দুর আর মাঝখান দিয়ে কালো ফিতের মত মসৃন এক চিলতে বিসর্পিল রাস্তা দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আমরা সকল বন্ধু বান্ধবীরা মিলে বেরিয়ে পরলাম ঝান্ডির সেই চা বাগান এ ঘুরতে।
আরও পড়ুন: ডায়মন্ড হারবার নদীপাড় সৌন্দর্য্যায়নের শিলান্যাস করলেন অভিষেক
উঁচু-নিচু টিলা এবং টিলাঘেরা সমতলে সবুজের চাষাবাদ। শুধু সবুজ আর সবুজ।মাঝে মাঝে টিলা বেষ্টিত ছোট ছোট জনপদ।প্রকৃতির সকল সৌন্দর্যের সম্মেলন যেন এখানে।এমন অন্তহীন সৌন্দর্যে একাকার হয়ে আছে এখানকার চা বাগান গুলো।চা বাগানে দাড়িয়ে নিজেদের নানান ছবি তুলে আমরা বেরিয়ে এলাম চা বাগান থেকে।
ভরপুর আনন্দ করতে করতে এবার চলে আসলাম আমরা আমাদের গন্তব্যস্থল লাভার পথে।পাহাড়ের মাথায় মুকুটের মতো সৌন্দর্যে ভরপুর এক হিমেল ঠিকানা হল লাভা।লাভা তে আসলেই আপনি দেখতে পাবেন কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ের ঢালে সারি সারি পাইনের বন।আর তারই মাঝে মাঝে সারি সারি বাক্সবন্দি বাড়ি।পাইন,ধুপির পরশ জড়ানো এ পথের বাঁকে বাঁকে শুধুই রোমাঞ্চ।প্রতি মুহূর্তে নানা বন্যপ্রাণের আনাগোনা।মাঝে মাঝে কুয়াশা এসে জড়িয়ে ধরে এখানে।অবশেষে দুপুরের দিকে আমরা লাভা তে পৌঁছলাম।ঠান্ডায় যেন সকলেই জড়ো সরো হয়ে পরলাম।চারিদিকে কুষাশা ঘেরা চারপাশ।
লাভা তে পৌঁছে আমরা সকলে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লাভা তে দেবিকা হোটেলে দিনে ডিম ভাত খেয়ে নিজেদের ঘরে সমস্ত জিনিসপত্র রেখে বেরিয়ে পরলাম লাভা মনাস্ট্রি দেখতে। যেখানে এসেই চোখ পড়ল মেঘমুক্ত আকাশে এই গুম্ফার বারান্দা থেকে হিমেল পর্বতশ্রেণীদের।
সুন্দর গুম্ফায় এখানে রয়েছে লামাদের স্কুল।এখানে এই বৌদ্ধ মন্দির পর্যবেক্ষণ এর একটি বিরাট কেন্দ্র ।সুন্দর মনাস্ট্রি,মেঘমুক্ত আকাশে এই গুম্ফার বারান্দা থেকে হিমেল পর্বতশ্রেণীদের দেখে আমরা সকলেই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে পরলাম এবং যে যার মতো ক্যামেরার লেন্স এ এখানকার অপরূপ দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করতে লেগে পরলাম।লাভা তে আসলে দেখা মিলবে
রেচেলা লা, জেলেপ লা-সহ নানা শৃঙ্গরাজের। লাভা থেকে রয়েছে নানা আকর্ষণীয় ট্রেকরুট। লাভা মনেস্ট্রী ছাড়াও লাভার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে,নেওরা ভ্যালী,চ্যাঙ্গী ঝর্না ইত্যাদি। এছাড়া লাভার খুব কাছেই রয়েছে লোলেগাও। তবে আমাদের শিক্ষা মূলক ভ্রমণের দেখার বিষয় ছিল লাভার অপরূপ লাভা মনস্ট্রি।
যেখান থেকে আমরা বিকেলে ঘুরে ফিরে এলাম আমাদের দেবিকা হোটেলে। ঘুরে এসেই আমাদের বিকেলের জলখাবার চা ও পাকোড়া দেওয়া হল এবং বলে দেওয়া হল রাতে ৮ টা ৮.৩০ এর মধ্যে যাতে আমরা রাতের খাবার খেতে চলে আসি।দিনে ডিম ভাত খেয়ে সকলের মন মেজাজ একটু খারাপ থাকায় রাতে আশা ছিল ভালো কিছু খাবারের।
তবে শুনতে পেলাম রাতে সকলের জন্য ফ্রাই রাইস ও চিলি চিকেনের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। ঠান্ডায় চিলি চিকেন ও ফ্রাই রাইস কথা শুনতেই আমাদের সকলের জিভে যেন জল চলে এলে। দিনে যাই হোক রাতে না হয় একটু ভালো কিছু পাবো সাথে সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সকলে নিজ নিজ ঘরে গেলাম। ঘরে গিয়ে ট্যাঙ্কির জলে হাত দিতেই মনে হল কেউ যেন হাতে বরফ চাপা দিয়েছে।
এত ঠান্ডা জল দেখেই ভয়ে শরীর যেন কেঁপে উঠলো আমাদের।সন্ধ্যা ৮ টা বাজতেই খাবার টেবিলে এলাম।কথা অনুযায়ী আমাদের জন্যে রাতে রান্না করা হয়ে ছিল চিলি চিকেন ও ফ্রাই রাইস। তবে আমাদের সেই চিলি চিকেন ও ফ্রাই রাইস দেখে সকলের চোখ দিয়ে যেন জল বেরিয়ে এল।
ফ্রাই রাইস ঠিক না ওটা ছিল গাজর ও ক্যাপসিকাম দিয়ে ভাজা দিনের ভাত ও চিলি চিকেন এর যে স্বাদ তা হয়ত খাইনি এর আগে কখন।পনিরের মত ছোট ছোট টুকরো করে পেয়াজ ও ক্যাপসিকামের সেই ঝোল খেয়েই কোন ক্রমে কেউ কেউ রুমে গেলাম।আবার অনেকে চিলি চিকেন ও ফ্রাই রাইসের মাত্রা ছাড়া সৌন্দর্য দেখেই সিদ্ধ ভাত ই অবশেষে মুখে তুলে নিল। আর ছিল সকলের জন্যে গরম জলের ব্যবস্থা। যে জল মুখে দিলেই হয়ত মুখ পুড়ে যাবে।সেই গরম গরম জলে মুখ ভিজিয়ে চলে এলাম নিজেদের ঘরে।
৩:৩০ এ রিশপ এর সূর্যোদয় দেখতে বেরিয়ে পড়ার কথা।আমরা সকলে খেয়ে রাত ৯ টা বাজতেই ঘুমোতে চলে এলাম।হঠাৎ রাত ১ টা সময় ঘুম ভেঙে গেল আমাদের আসে পাশের ঘরের সকলের।রাত কাটলো পেট ব্যাথা নিয়ে।তারপর কোনো মতে ৩:৩০ বাজতেই রেডি হয়ে হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম।আমাদের সকলের পেটের অবস্হা দেখে স্যার ম্যাডাম রা সকলেই প্রায় চিন্তিত হয়ে পরল।ম্যাম এক এক করে ৭০ জন ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে পেট ব্যথার ওষুধ বিতরন করতে থাকলেন।জলের ঠিক মতো কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ছেলেরা অনেকেই জল ছাড়াই ওষুধ মুখে দিয়ে উঠে পরলো নিজের নিজের গাড়িতে।কোনো মতে বেরিয়ে পরলাম রিসপ এর সূর্যোদয় দেখতে।
প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায় লেপচা অধ্যুষিত গ্রাম রিশপ (Rishyap) যা লাভা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত৷পাহাড়ের ধাপে ধাপে নানা রকমের ফুলে ঢাকা ছোট্ট সাজানো গ্রাম রিশপ।রিশপ এর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চাষের জমি দেখতে যেন অপূর্ব লাগে৷ পেটের খারাপ অবস্থার মধ্যেও যেন ভোর বেলায় রিশপের সেই সুন্দর দৃশ্য মনকে খানিক টাও শান্তি প্রদান করবে।
রিশপ এর মধ্যযুগীয় সেই কাঁচারাস্তা র আর চারিদিকে এবড়ো খেবরো পাথর এর উপর দিক দিয়ে আমাদের ড্রাইভার দাদা গাড়ি নিয়ে গেলেন।রিশপ যেহেতু ছোট একটা গ্রাম, তাই লাভার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল জায়গাটা। বিদ্যুতের অনিয়মিত সরবরাহও এখানকার অন্যতম প্রধান সমস্যা।জলের সঙ্কটেও ভোগেন স্থানীয়েরা।কাজেই পর্যটকদের বার বার করে বলে দেওয়া হয়, এখানে গিয়ে জলের অপচয় না করতে।
রিশপকে ঘিরে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু, সিনিয়ালচু, পান্ডিম—সহ নানান শৃঙ্গ৷ সারা রিশপে সবসময় অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করে৷ জঙ্গলের মধ্যে ট্রেক করে আমরা পৌঁছে গেলাম দেড় কিলোমিটার দূরের টিফিনদাঁড়া ভিউপয়েন্ট৷ সান্দাকফুর পর রিশপের টিফিনদাঁড়া হল পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম ভিউ পয়েন্ট৷ এখান থেকে সূর্যোদয়, সূর্যান্ত দেখার অভিজ্ঞতা ভোলার নয়৷ আমরা সকলে এখানে সূর্যোদয় দেখে সূর্যোদয়ের কিছু ছবি নিজেদের ক্যামেরা বন্দী করলাম
এমন সময় দেখি পেটের ব্যথায় কাবু হয়ে আমাদের কিছু বন্ধু বান্ধব বাথরুম খুঁজে বেরোচ্ছিল। তাদের সাথ এ ম্যাডাম রা ও বাথরুম খুঁজতে সহযোগিতা করছিলেন।পেট খারাপ এ নাকাল হয়ে অবশেষে যে এমন কাণ্ড কারখানা বাঁধিয়ে ফেলবে ছাত্র ছাত্রীরা এটা হয়ত ধারনার বাইরে ছিল সকল স্যার ম্যাডামদের।তবে কি আর করা যাবে অবশেষে দেরি না করে তড়িঘড়ি করে আমাদের সকল কে হোটেলে ফেরত আনা হল।হোটেলে ঢুকতে না ঢুকতেই সকলেই যেন বাথরুমে যাওয়ার জন্য চিৎকার করতে লাগলো। যে যার মতো দৌড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এখুনি বসে পড়বে কোথাও।
তবে ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই হাজার হোক সকলেরই তো লজ্জা বলে কিছু রয়েছে।তাই চিৎকার করতে করতে কিছু মেয়েরা ছেলেদের বের করে তাদের বাথরুমে গেল এবং বাকি কিছু ছেলেরা জঙ্গল খুঁজতে বেরিয়ে পরলো।জটিল এই অবস্থা দেখে স্যার ম্যাডাম রাও সেই সময় যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ছাত্র ছাত্রীদের সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যেতে তারাও তৎপর।তাই দেরি না করে তারা ওয়ারেস ও মেট্রোজেন এর ৮০ টা প্যাকেট কিনে সকল কে সাপ্লাই করতে লাগলেন।যাক অবশেষে সুস্থ হতেই আমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার পালা লাভা থেকে।তাই সকলে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছিল।
ছাত্র ছাত্রীদের এমন পরিস্থিতি দেখে স্যার রা দুপুরের দিকে সকল কে সিদ্ধ ভাত ও ডিম এর অমলেট খাওয়া পরামর্শ দিলেন। সকলে স্যার দের কথা মতো সামান্য সিদ্ধ ভাত কেউ কেউ মুখে দেয় আর কেউ কেউ ভয়েই কিছু না খেয়ে শুধু একটু বিশ্রাম নিয়ে লাভা থেকে শিলিগুড়ি তে রওনা দিতে গাড়ি তে বসে পরে। শিলিগুড়ি থেকে বিকাল ৫ .৩০ এ আমাদের ট্রেন ছিল কালিয়াগঞ্জ এ ফিরে যাওয়ার।
আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছাই তখন বাজে বিকেল ৩.৩০। ওখানে স্যার রা সকল কে কিছু খেয়ে নিতে বলেন। কেউ কেউ মাছ ভাত খেতে হোটেলে ঢুকে যায় আবার কেউ কেউ শুধু মোমো খেয়ে বসে পড়ে ট্রেনে। সকলে ট্রেনে বসে মনে পরে লাভার সেই ভয়াবহ স্মৃতি। সেই স্মৃতি নিয়ে সবাই হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরে। তবে প্রকৃতির স্বর্গীয় অনুভূতির কাছে ছাত্র ছাত্রীদের সামান্য কিছু সমস্যা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে যাই হোক সকলেই স্মৃতির পটে এই ঘটনা চিরস্থায়ী হয়ে রইবে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584