ভূতচতুর্দশীর তাৎপর্য- সংহিতা দেব

    0
    956

    ভূতচতুর্দশীর তাৎপর্য-

    সংহিতা দেব

    “জ্বালাও আলো আপন আলো জয় কর এই তামসিরে” শুভ ভুতচতুর্দশী।

    সংহিতা দেব

    পঞ্জিকামতে আজ আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথি, এই দিনটাকে ভূত চতুর্দশী বলা হয়। মাতৃ দিবস, পিতৃ দিবস,শিক্ষক দিবস,প্রেম দিবস,নারী দিবস ইত‍্যাদির মতোই আজ ভূত দিবস। এই দিনে চৌদ্দ শাক খেয়ে আর চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চৌদ্দ পুরুষের অতৃপ্ত আত্মাদের তুষ্ট করে, অশুভ শক্তিকে দূর করার রেওয়াজ। দীপাবলির আগের দিন সাধারনত ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়।

    আমাদের ভূত চতুর্দশী বিদেশে “হ্যালোউইন” নামে পালিত হয়।হ্যালোউইন`কে পৃথিবীর কোথাও কোথাও `অল হ্যালোস ইভ`ও বলা হয়। অক্টোবর মাসের শেষ দিনে বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় হ্যালোউইন। কুমড়ো দিয়ে গা ছমছমে মুখোশ বানিয়ে লন্ঠন জ্বালিয়ে ভূতুড়ে পোষাকে `হ্যালোউইন` উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। অতৃপ্ত আত্মাদের বিদায় জানানোই উদ্দেশ্য।এই অশুভ দিনটিকে “নরক চতুর্দশী”ও বলে। রাক্ষসরাজ নরকাসুরেরকে পরাজিত করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়লাভের স্মৃতিচারণ করতে, এই উৎসব উদযাপিত করা হয়। একটি সাদা কুমড়োকে ভেঙ্গে তাতে সিঁদুর বা কুমকুম লাগানো হয়। রাক্ষসরাজ নরকাসুরের মস্তকের প্রতিরূপ এই কুমড়ো। এই নরক চতুর্দশীর পৌরানিক কাহিনী হল, রাক্ষসরাজ নরকাসুর ভগবান ইন্দ্রকে পরাজিত করে দেবমাতা অদিতির কানের বালা ছিনিয়ে নিয়ে শাসক হয়ে বসেন। নরকাসুর, দেবতা ও ঋষিমুনিদের ১৬০০০ কন্যাদেরও তার অন্তঃপুরে বন্দী করে রাখেন।নরক চতুর্দশীর আগের দিন, শ্রী কৃষ্ণ নরকাসুরের নিধন করে, ঐ কুমারী কন্যাদের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করেন এবং দেবমাতা অদিতির বহু মূল্যবান কানবালাও উদ্ধার করেন। এইভাবেই, অশুভের ওপর শুভর জয়কে উদযাপন করতেই, নরক চতুর্দশী পালিত হয়ে থাকে।
    আরেকটি কিংবদন্তীতে রয়েছে, বলশালী রাজা বালী ভগবানদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিলেন। তার প্রতিপত্তি খর্ব করতে ভগবান বিষ্ণু বামন অবতারের রূপ ধারণ করেন এবং রাজা বালীর কাছে শুধুমাত্র নিজের তিন পদক্ষেপ সমান জমি ভিক্ষা করেন।নিজের দানশীলতার জন্য খাত রাজা বালী এই ভিক্ষা মঞ্জুর করেন। ঠিক সেই মুহুর্তে সেই ক্ষুদ্র মানুষটি নিজেকে, শর্বশক্তিমান ভগবান বিষ্ণুতে রুপান্তরিত করে নেন। ভগবান বিষ্ণু, তাঁর প্রথম পদক্ষেপ রাখেন, স্বর্গ-এ, দ্বিতীয় পদক্ষেপ মর্ত্য়ে এবং, তৃতীয় পদক্ষেপ কোথায় রাখবেন তা জিজ্ঞাসা করেন, রাজা বালীকে। বালী নিজের মাথা পেতে দেন। রাজার মাথায় পা রেখে ভগবান বিষ্ণু তাকে নরকে ঠেলে দেন। একইসময়ে রাজার উদারতার কথা মনে রেখে, ভগবান বিষ্ণু তাকে জ্ঞানের প্রদীপ দান করেন এবং বছরে একবার মর্ত্যে ফিরে এসে কোটি কোটি প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেন। এই প্রদীপই অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে এবং প্রেম ও জ্ঞানের প্রভা বিস্তার করে। এইভাবেই নরক চতুর্দশীতে, অশুভের ওপর শুভ, অন্ধকারের ওপর আলো এবং অজ্ঞানতার ওপর জ্ঞানের বিজয়কে উদযাপন করা হয়।

    ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে নরক চতুর্দশীর ধার্মিক রীতি ও কিংবদন্তীও ভিন্ন । দক্ষিণ ভারতের, লোকেরা সিঁদুর ও তেল দিয়ে একধরণের লেপ বানানোর জন্য অনেক ভোরবেলাতেই ঘুম থেকে উঠে পরেন। এটিকে তারা “উবটন” বলেন এবং নিজেদের কপালে এটি লাগিয়ে তারা স্নান করে, “ছোট দীপাবলি” নামেও এইদিন জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গে লোকেরা এইদিনে ১৪ রকমের শাক রান্না করে এবং সন্ধ্যায় চোদ্দ বাতি জ্বালিয়ে থাকে, যা সূচিত করে চতুর্দশী-কে । পরেরদিন, অমবস্যায় কালীপূজা করা হয়ে থাকে। এইভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ নরকচতুর্দশী, সারা ভারতব্যাপী পালন করা হয়। পৌরাণিক গল্পে রাজা হিমুর পুত্রের অকাল মৃত্যুকে আটকেছিলেন তার বুদ্ধিমতি পুত্রবধু। শর্পরূপী যমরাজ যখন মধ্যরাতে তাদের শয়নকক্ষে এলেন সোনারূপা স্তুপ করে দরজা বন্ধ করে প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন নববিবাহিতা বধূ। গয়নার জ্যোতিতে চোখ ঝলসে রাজপুত্রের প্রান না নিয়ে ফিরে গেছিলেন যমরাজ। সে কারণেও সোনারূপা ক্রয় করা হয় ধনতেরসের দিন, তারপর দিন অকাল মৃত্যুকে রোধ করতে এই নরক চতুর্দশীর প্রদীপ প্রজ্জ্বলন।

    ছোটবেলা থেকেই আমি মা বাবার পিছনে নেচে নেচে প্রদীপ জ্বালাতাম আর কল্পনার অতলে তলিয়ে শিহরিত হতাম এইভেবে যে, একটা করে মামদো ভূত,শাকচুন্নি,ব্রেহ্মদত্তি,সরুভূত, মোটাভূত, লম্বাভূত, বেঁটেভূত সব্বাই আজ পরাজিত। লেজ গুটিয়ে ভাগছে সব।এখন এই গল্পই গেঁথে দি আমার ছেলের মনেও,সেও অজস্র প্রশ্নে বিস্মিত শিশুমনে চকিত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আজানা আশংকায় ভূত খুঁজতে খুঁজতে প্রদীপ জ্বালায়।আমি মনে মনে করজোড়ে ঈশ্বরকে বলি, আমাদের নিজেরই অন্তরে লোভ,ক্রোধ, হিংসা,কাম, মোহ,ঈর্ষা,দ্বেষ রূপী কত ভূতের যে বাস। চোদ্দপ্রদীপে তো আমরা এই ভূতদের তাড়াতে পারিনা। ঈশ্বর যেন কোন শক্তিবলে সেই সলতেটুকু জ্বালিয়ে দেন আমাদের সন্তানদের মনে। তারা যেন সংস্কারমুক্ত, ভূতমুক্ত জীবন পায়। সকল অজ্ঞানতাকে অতিক্রম করে তারা যেন জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোর রোশনাই এ ভরে তুলতে পারে নিজেদের জীবন……
    “যাক অবসাদ বিষাদকালো
    দীপালিকায় জ্বালাও আলো…
    জ্বালাও আলো, আপন আলো জয় কর এই তামসীরে…..”

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here