ইতিহাস বিকৃতি ও ইতিহাস চর্চার ভিত্তিঃ আলোচনায় রোমিলা থাপার

    0
    626

    ইতিহাস বিকৃতি ও ইতিহাস চর্চার ভিত্তিঃ আলোচনায় রোমিলা থাপার

    ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার ও ‘হিস্ট্রি ফর পিস্‌’ সংস্থার পক্ষ থেকে দেবী কর

    সুমিত ঘোষ,কোলকাতা:-

    হিস্ট্রি ফর পিস্‌’ সংস্থার উদ্যোগে ২৪শে ডিসেম্বর, ২০১৭-য় ভবানীপুরের ‘সিগাল ফাউন্ডেশান ফর দি আর্টস’-এর প্রেক্ষাগৃহে বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপারের সঙ্গে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা (কেবল ইতিহাস নয়, অন্যান্য বিষয়, এমনকি পদার্থবিদ্যার শিক্ষিকারাও উপস্থিত ছিলেন- যা আমাদের পাঠ্য বিষয়গুলির মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সংযুক্ত প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তাকেই ফুটিয়ে তুলেছে), ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র বিভিন্ন সদস্যরা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পড়ুয়া (বিশেষ করে ইতিহাস, শিক্ষা বিজ্ঞান শাখার অ্যাকাডেমিক মহল), ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ’-এর কিছু সদস্য, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পত্রিকা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। ‘হিস্ট্রি ফর পিস্‌’ সংস্থার পক্ষ থেকে দেবী কর এবং অঞ্জুম কাটয়ালের পরিচালনায় ইতিহাস চর্চার বিভিন্ন দিক নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

    তাঁর লেখা বই

    রোমিলা থাপারের একটি পূর্বতন উক্তিকে পাথেয় করেই সভার সূচনা হয়- ‘অবজেক্টিভ ইতিহাস বলে পূর্ণরূপে কিছু হয়না; সবসময় কোনও না কোনও ভাবে সে পক্ষপাত দুষ্ট হবেই। ফলে সেই পক্ষপাতকে বোঝাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ’। এই বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই তিনি বলেন যে ‘ইতিহাস’ আমাদের অতীতের ‘সত্য’ উদ্ঘাটন করতে নয়, বরং অতীতকেই ‘বুঝতে’ শেখায়। কোনও ঐতিহাসিক তথ্যের উৎসকে তাহলে কিভাবে দেখব? মাপকাঠিগুলি কি? এই প্রশ্নে তিনি ‘মনুস্মৃতি’ বা কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এর উদাহরণ টেনে বলেন যে উভয়ই ম্যানিফেস্টো স্বরূপ- ‘কিরকম ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে’-এর বদলে ‘কি হওয়া উচিত’ নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। উভয়ই হাত বদল হতে হতে বারংবার সংশোধিত হয়েছে- ফলে এদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এদের স্রষ্টা(দের) ‘ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাকগ্রাউন্ড’ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। ‘পোস্ট মর্ডানিজম’-এর প্রসঙ্গ উঠে এলে তিনি বলেন যে এই মতধারা একই বস্তু বা ঘটনার বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণকে সমগুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে যা বিপজ্জনক- উদাহরণ স্বরূপ মৃৎশিল্প সম্পর্কে লিখিত তথ্য এবং একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে আবিষ্কৃত ‘নীললোহিত’ পট-এর মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই বেশী গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিদ্যালয়ের শিক্ষিকারা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিহাস বিকৃতি ও পাঠ্যক্রমে তাদের প্রভাব সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করলে তিনি বলেন যে বর্তমান উগ্রদক্ষিণপন্থী রাজনীতির উৎসই হল ঔপনিবেশিক ইতিহাসবাদিতা যা ভারতীয় ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে হিন্দু (আদি যুগ), মুসলিম (মধ্য যুগ) ও ব্রিটিশ (আধুনিক যুগ) ইতিহাসে বিভক্ত করে। এই প্রবণতার বিরোধিতা করে তিনি ৮শো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আদি যুগ, ৮শো থেকে ১৪শো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাথমিক মধ্য যুগ, ১৪শো থেকে ১৭শো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্য যুগ, ১৮শো খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রাক্‌ আধুনিক এবং ১৯শো খ্রিস্টাব্দ থেকে আধুনিক যুগে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে বিভক্ত করার পক্ষে সওয়াল করেন।

    বিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ্যবইতে ঘটনার ক্রমান্বয়তা বজায় রাখতে এবং শুধুই ঘটনার ঘনঘটার বদলে ঘটনা ও ব্যাখ্যার মেলবন্ধনের কথা বলেন তিনি। গেরুয়া সাংসদ মুরলী মনোহর যোশী যাঁকে ‘অ্যাকাডেমিক সন্ত্রাসবাদী’-র আখ্যা দিয়েছিলেন, সেই ‘সোমনাথঃ দ্য মেনি ভইসেস অফ হিস্ট্রি’-র রচয়িতাকে হিন্দু রাষ্ট্রের বৈধতা, ভারতীয় সমাজ, গো হত্যা কিংবা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না তা হতেই পারে না। এই প্রসঙ্গে তিনি ভারতীয় ‘উপমহাদেশ’-এর সমাজকে একটি বহু সাংস্কৃতিক সমাজ হিসেবে অবিহিত করেন। তিনি বলেন যে আদি ও মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজে ধর্ম ছিল বিকেন্দ্রীভূত, বহুত্ববাদী; রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেনি তখনও। হিন্দুত্ববাদ একটি ১৯শো খ্রিস্টাব্দ ঔপনিবেশিক আবিষ্কার। ১৫শো খ্রিস্টাব্দের আগে ‘মুসলিম’ শব্দটিও  আসেনি; তার আগে শত্রু শব্দে সাম্প্রদায়িক ভিত্তি ছিল না-এই শব্দের অন্তর্গত ছিল যবন, তাজেক, তুরুস্করা। তাছাড়া সাহিত্যে সংস্কৃতের অস্তিত্ব ছিল ১৭শো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত; তারপর তামিল, ব্রজ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার উত্থান হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক লেনদেনভিত্তিক সাম্প্রদায়িক মৈত্রী প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে আকবরের রাজসভায় সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ করা হত এবং সোমনাথ মন্দিরের অর্থ সাহায্যে মসজিদও তৈরি হয়েছিল। অর্থনৈতিক সমঝোতার অভাবই ছিল স্থাপত্য ধ্বংসের কারণ যা অন্যান্য রাজ্যের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলত না। বুর্জোয়া শাসন কায়েমের আগে রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট সীমারেখার অভাবের ফলে ‘অখণ্ড ভারত’-এর বর্ডার নিয়েও সওয়াল করেন তিনি। গো হত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে ঋক বেদের যুগে মানুষ ছিল মূলত পাশুপালক এবং আংশিক কৃষক; পরবর্তীতে কৃষিই জীবিকার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। যে পশুকে দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়, তাদের বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া খাওয়ার চল ছিল না। গুপ্তযুগে দলিতরা একদিকে যেমন মৃত পশুদের ভক্ষণ করে জীবনধারণ করত তেমনই অন্যদিকে জমি ও গবাদি পশু ব্রাহ্মণদের দান করার রীতি ছিল। ফলে গবাদি পশু ভক্ষণের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদী বিরোধের ভিত্তি এই পরিস্থিতি থেকেই। তিনি আরও বলেন যে উপনিষদে হৃষ্টপুষ্ট সন্তান পাওয়ার জন্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ভাতের সঙ্গে গো মাংস খাওয়ানোর উপদেশ দেওয়া রয়েছে। তাছাড়া ‘আর্য অধিক্রম’ তত্ত্বের বিরোধী স্বয়ং বি. বি. লালও হস্তিনাপুরের খনন কার্যের শেষে ধ্বংসাবশেষের রসুই থেকে ছুরির চিহ্ন সমেত গবাদি পশুর হাড় পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।

    গো হত্যার রাজনীতির ফলে আজকের দিনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেই কৃষক যে তার বৃদ্ধ গো মহিষ কষাইখানায় বেচতে পারছে না। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে ১৮৭২-এর সেন্সাসের আগে এই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারণাই ছিল না-এটা আরও একটি ঔপনিবেশিক আবিষ্কার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহল ইতিহাস লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ‘কিভাবে’ এবং ‘কেন’ প্রশ্নের উপর জোর দিতে বলেন ইতিহাসবিদদের। পরিশেষে, তিনি বলেন যে অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তে রাষ্ট্রকে অগণতান্ত্রিক হতে গেলে নিজের ভেতর থেকে শত্রু বের করতে হয়। নাৎসিদের সময় যারা ছিল ইহুদি, বর্তমান হিন্দু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তারাই মুসলমান সমাজ।

    অ্যাক্টিভিস্টদের উজ্জীবিত করে তাঁর আলোচনা সভা শেষের মুখে সাংবাদিকদের আহ্বান ছিল ‘আপনি প্রত্যক্ষ অ্যাক্টিভিজম-এ উত্তীর্ণ হন’; তাঁর দৃপ্ত উত্তর- ‘অ্যাক্টিভিস্টরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামুক, আমি আমার তথ্যের ভাণ্ডার নিয়ে তাদের পিছনে দাঁড়াব’।  

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here