কলকাতার গির্জার ইতিকথা-শুভশ্রী মৈত্র

    0
    607

    ২৫শে ডিসেম্বর, বিশ্বজুড়ে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী সকলে পালন করবেন তাঁদের সব থেকে বড়ো উৎসব৷ গির্জায় গির্জায় প্রার্থনাসভা৷ এই প্রসঙ্গে কলকাতা শহরের কয়েকটি গির্জা সম্পর্কে কিছু কথাশুভশ্রী মৈত্র

    লেখিকা

    কলকাতা শহরে খ্রিষ্টানদের উপাসনার জন্যে প্রথম যে বাড়িটি তৈরি হয়েছিল তা কোনও গির্জা নয়, ছোট একটা উপাসনাগৃহ৷ এখনকার জিপিও-রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অঞ্চলে ছিল ইংরেজদের প্রথম কুঠি ও দুর্গ৷ তার মধ্যেই ছিল সেই উপাসনাগৃহ৷ তার পর বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে আর্মেনিয়ান চার্চ (১৭০৭), সেন্ট অ্যান’স চার্চ (১৭০৯), মিশন চার্চ (১৭৭০), সেন্ট জন্ স্ চার্চ (১৭৮৭), পর্তুগিজ চার্চ (১৭৯৯), সেন্ট অ্যান্ড্রূজ চার্চ (১৮১৮), সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল (১৮৪৭), সেন্ট জেমস চার্চ (১৮৬৮), সেন্ট মেরিজ চার্চ (১৮৮৭), গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ (১৯২৫) আরও অনেক গির্জা৷

    আর্মেনিয়ান চার্চ: ব্রেবোর্ন রোড

    (সমস্ত ছবিই-সংগৃহিত) আর্মেনিয়ান চার্চ

    এই মুহূর্তে কলকাতা শহরের প্রাচীনতম খ্রিস্টিয় গির্জা বলে মনে করা হয় ব্রেবোর্ন রোডের আর্মেনিয়ান চার্চকে৷ বাণিজ্যের কারনে পর্তুর্গিজ, দিনেমারদের মতো আর্মেনিরাও কলকাতায় এসেছিল ব্রিটিশদের আগে৷ আজকের ব্র্যাবোর্ন রোড, চিনাবাজার অঞ্চলে ছিল তাদের প্রধান বসতি এবং একটি কবরস্থান৷ এই কবরস্থানটি কলকাতার ইতিহাসে আরও একটি কারণে উল্লেখযোগ্য৷ এখানেই পাওয়া যায় শহরের প্রাচীনতম সমাধিলিপিটি৷ ঐ ফলকে লেখা আছে ১৬৩০ সালে ১১ জুলাই রেজাবিবি নামে এক আরমেনি মহিলা মারা যান যা আর্মেনিদের কলকাতাবাসের প্রাচীনত্বের প্রমাণ বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ৷

    সেন্ট অ্যান’স চার্চ: ফোর্ট উইলিয়াম
    শহর কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জা ছিল সেন্ট অ্যান’স চার্চ ৷ এটি ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরি করা প্রথম প্রেসিডেন্সি চার্চ৷ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভিতরে ইংরেজরা তাদের উপাসনার জন্য ১৭০৯-তে এই চার্চটি তৈরি করে৷ ইংরেজ ব্যবসায়ীদের চাঁদায় তৈরি এই চার্চের নাম রাখা হয় কুইন অ্যানের নামে- ‘সেন্ট অ্যানস্ চার্চ’৷

    ওল্ড অর মিশন চার্চ/ লাল গির্জা: লালবাজার
    বর্তমান লালবাজার অঞ্চলের মিশন চার্চ বা লাল গির্জার প্রতিষ্ঠাতা রেভারেন্ড জন জ্যাকারিয়াস কিয়েরন্যানডার ছিলেন সুইডেনের বাসিন্দা৷ ১৭৩৯-এ ভারতে এসে তিনি প্রথমে পণ্ডিচেরির দক্ষিণে কুডডালোর নামক একটা জায়গায় ধর্মপ্রচার আরম্ভ করেন৷ পলাশির যুদ্ধের পরে ওই অঞ্চলে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব আরম্ভ হলে কিয়েরন্যানডার কলকাতায় পালিয়ে এসে অ্যান উলি নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেন এবং প্রভূত সম্পত্তির মালিক হন। তিনি নিজে মিশনারি হিসেবে একটা গির্জা স্থাপন করতে উদ্যোগী হন এবং তাঁর উদ্যোগে বর্তমান বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগের কাছাকাছি একটি জমিতে ১৭৬৭-র মে মাসে গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়৷ ১৭৭০-এর ২৩ ডিসেম্বর বিশেষ প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয় গির্জার কাজ৷ এই চার্চের নামেই পরবর্তীকালে সামনের রাস্তার নামকরণ করা হয় মিশন রো৷ প্রথমে গির্জার দেওয়ালে শুধু লাল ইট থাকায় লোকে ‘লাল গির্জা’ বলত৷
    আরও একটি কারণে গির্জাটি বিখ্যাত, এই মিশন চার্চেই ১৮৪৩-এর ৯ ফেব্রুয়ারি মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন৷

    সেন্ট জন’স্ চার্চ/ পাথুরে গির্জা:কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট 
    ১৭৫৬-তে সিরাজ-উদ-দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময়ে সেন্ট অ্যানিস চার্চ ধ্বংস হওয়ার পর ইংরেজরা সাময়িক ভাবে মুরগিহাটায় পর্তুর্‌গিজ চার্চকে প্যারিস চার্চ হিসেবে ব্যবহার করত৷ ১৭৬০-এ গির্জাটি পুনরায় পর্তুর্‌গিজদের ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়৷ ওই সময় থেকে পুরনো কেল্লার কাছে একটি ঘর তৈরি করে প্রেসিডেন্সি চার্চ বা উপাসনালয় হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে ইংরেজরা।
    তারপরে সেন্ট জনস গির্জা তৈরি হয় বিভিন্ন মানুষের দানে এবং কিছুটা লটারি করে তোলা টাকায়৷ ১৭৮৪-এর ৮ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়৷ প্রাচীন গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে চার্চ তৈরির জন্য নিয়ে আসা হয় মার্বেল পাথর৷ গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে লন্ডনের ওয়াকব্লকের সেন্ট স্টিফেন চার্চের আদলে তৈরি গির্জাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় সেন্ট জন দ্য ব্যপটিস্টের জন্মদিনে, ১৭৮৭-এর ২৪ জুন৷ সে জন্য গির্জার নাম হয় সেন্ট জনস চার্চ৷ সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি বলে লোকমুখে নাম হয়ে যায় ‘পাথুরে গির্জা’৷

    সেন্ট অ্যানড্রুজ স্কটিশ চার্চ: বিবাদি বাগ
    কলকাতার অন্যতম স্কটিশ গির্জা সাবেক ডালহৌসি স্কোয়ার অঞ্চলের সেন্ট অ্যানড্রুজ চার্চ৷ গ্রিক স্থাপত্যে নির্মিত এই চার্চটির জায়গায় আগে ছিল পুরনো মেয়রর্স কোর্ট৷ ১৭২৭-এর রাজকীয় সনদ অনুসারে সেখানে ১ জন মেয়রের তত্ত্বাবধানে ইউরোপিয়দের বিচার হত৷ পরে, ১৭৯২-এ ওই আদালত বাডি়টি ভেঙে ফেলা হয় কিন্ত্ত পুরনো আদালত ভবনকে স্মরণে রেখে সামনের রাস্তার নাম করা হয় ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট৷ আনুমানিক ১৮১৫ সাল নাগাদ ওই জায়গাটি চার্চ তৈরির জন্য স্কটিশদের দেওয়া হয়৷ সেন্ট অ্যানড্রুজ ডে’-তে লর্ড ময়রার উপস্থিতিতে মার্কুইস অফ হেস্টিংস গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন৷ ৮ মার্চ ১৮১৮-এ জেমস ব্রাইসি গির্জার উদ্বোধন করেন৷ তিনি সেন্ট অ্যানড্রুজ-এর নামে গির্জার নামকরণ করেন৷ ১৮৩৫ সালে ৫০০০ টাকা দামের ঘডি় বসানো হয় গির্জার টাওয়ারে৷ ভিতরে আছে বেশ কয়েকটি মূল্যবান তৈলচিত্রও৷

    পর্তুগিজ চার্চ: মুরগিহাটা (ব্রেবোর্ন রোড)
    পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা প্রথম ভারতে আসেন ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে৷ তিনি বঙ্গদেশে না এলেও তার আসার মাত্র উনিশ বছর পরেই, ১৫১৭-এ আর এক পর্তুগিজ নাবিক ডি জোয়াও সিলভেরিয়া বাণিজ্যতরী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসেন৷ তাঁদের কাছে তখন বাংলায় বানিজ্য করার অনুমতি ছিলনা, তার পর নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে পর্তুগিজরা শেষ পর্যন্ত বাংলায় বাণিজ্য করবার অনুমতি লাভ করে৷ ষোড়ষ শতকের শেষ দিক থেকে বাংলার পশ্চিম অংশে এসে সন্তগ্রাম, হুগলি, ব্যান্ডেল প্রভৃতি অংশ ঘুরে পর্তুগিজরা কলকাতায় বসতি স্থাপন করে সন্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে৷ ইংরেজ বণিক জোব চার্নক মুঘলদের সঙ্গে বিরোধ করে যখন সুতানুটি আসেন পর্তুগিজরা তত দিনে এই অঞ্চলে তাদের ক্ষমতা বিস্তার করে ফেলেছে৷ খানিকটা তাদের সহায়তা নিয়েই জোব চার্নক এখানে বসতি তৈরি করেন৷ সেখানে খড়ের চালা দেওয়া একটা অস্থায়ী উপাসনাগারও তৈরি করে তারা৷ প্রচীনতম ধরলে সেটাই ছিল কলকাতার আদি খ্রিস্ট উপাসনালয়৷ কেউ কেউ বলেন, ১৬৯৩-এ চার্নকের মৃত্যুর পর জন গোল্ডসবরো সুতানুটি থেকে কুঠি তুলে পর্তুগিজদের কুঠি থেকে বিতাড়িত করে তাদের জায়গা দখল করে ঘাঁটি তৈরি করেন৷ সেই জায়গাটা হল এখনকার ডালহৌসির জিপিও এলাকা৷ বিতাড়িত পর্তুগিজরা খানিকটা দূরে এখনকার মুরগিহাটা অঞ্চলে চলে যায় এবং আর একটা উপাসনালয় তৈরি করে৷ তবে সেটি ছিল অস্থায়ী কাঠামো৷ পরে ১৭৯৭-তে নতুন গির্জাভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়৷ জেমস্ ড্রাইভারের পরিকল্পনায় তৈরি গির্জা তৈরিতে খরচ হয় নব্বই হাজার সিক্কা টাকা৷ পর্তুগিজ ধনী ব্যবসায়ী ব্যারেটো অনেক টাকা দান করেন ওই গির্জার জন্যে৷ নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হলে রোসারি ভার্জিন মেরির নামে উত্সর্গ করে, ১৭৯৯ সালের ২৭ নভেম্বর চার্চ খুলে দেওয়া হয়৷ দু’দিকে দু’টি মিনার, মাঝে ত্রিভুজাকৃতি চুড়োর গঠন এই চার্চ কলকাতার অন্যতম সুন্দর-দর্শন গির্জা৷

    সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল: ক্যাথিড্রাল রোড
    শহর কলকাতার অন্যতম সুন্দর দর্শন ‘অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রাল’ গির্জা হল সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল৷ ১৮১৪ পর্যন্ত সেন্ট জনস চার্চ প্রেসিডেন্সি চার্চ ছিল৷ তার পরে শহররের খ্রিস্টীয় সমাজকে বিশপের অধীনে আনা হয়৷ বিশপ মিডলটনের উদ্যোগে ১৮১৯ নাগাদ সেন্ট জনস গির্জার পাশাপাশি আরও একটা গির্জা নির্মাণের চিন্তা আসে কলকাতার খ্রিস্টীয় সমাজপতিদের৷ তারই ফলস্বরূপ শহর কলকাতার সাহেবপাড়ার কাছাকাছি কোথাও তৈরি হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়৷ ১৮৩৯-এর ৮ অক্টোবর বিরজি তলাওয়ের পাশে ক্যাপটেন ডবলিউ এন ফরবেশের নকশা অনুসারে নির্মীয়মাণ গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়৷ ইন্দো-গথিক স্থাপত্যের ওই গির্জা নির্মাণ সম্পূর্ণ হল প্রায় আট বছর পরে৷ ১৮৪৭-এর অক্টোবরে গির্জা খুলে দেওয়া হল উপাসনার জন্য৷

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here