মীর রাকেশ রৌশান
একদা বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ। আর বাংলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিকের কথা উঠে আসলেই যে শহরের নাম আসে তার মধ্যে কোলকাতা ঢাকার পরেই বহরমপুর।যদিও ভারতবর্ষের লোকসংস্কৃতির মক্কা বলা যেতে পারে মুর্শিদাবাদকে।তারপর ভাগীরথী দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল।সেই জলে ভেসে হারিয়ে গেছে অনেক আঙ্গিক কিছু আঙ্গিক বিলুপ্তিরর পথে।মুর্শিদাবাদ জেলার শিল্পী সাহিত্যিকদের চর্চার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালের ৩১ মে একটি কনভেনশন করে গ্রান্ট হলের পাশে অর্ধেন্দু সিংহ নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে গঠিত হয় মুর্শিদাবাদ জেলা ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ।সেই সঙ্ঘ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় একটি কার্যকরী কমিটি যার সভাপতি ছিলেন সেই সময়ের মধ্যবঙ্গের অন্যতম এসরাজ শিল্পী ভনীভূষন মুখার্জী আর সম্পাদক হন মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম সেরা গণসঙ্গীত শিল্পী সুধীন সেন।সুধীন সেনকে শুধু গণসঙ্গীত শিল্পী বললে তাঁর ব্যাপ্তিকে সীমাবদ্ধ করা হবে।তিনি ছিলেন গণসঙ্গীত শিল্পী চিত্র শিল্পী এবং লেখক।বলা যেতে পারে সেই সময়ের মুর্শিদাবাদ জেলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র।

আর সেই সময় পর্বকে মুর্শিদাবাদ জেলার শিল্প সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বললে অত্যুক্তি করা হবে না।গণনাট্যের সঙ্গে ছিলেন শিবাজী কুমার রাহা,প্রশান্ত ফোচলেন,শৈলেশ কুমার রাহা,গণপতি সান্যাল,গোপীনাথ সান্যাল সর্বোপরি চারণ কবি গুমানী দেওয়ান।গুমানী দেওয়ান শুধু মুর্শিদাবাদ নয় অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ঠ চারণ কবি এবং আধুনিক চারণ কবিগানের রূপকার।ভোলা ময়রা,অ্যান্টনি ফিরিঙ্গীর পর তাঁর নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয়।সৈয়দ মুজতবা সিরাজের কথায় তিনি হলেন চারণ সম্রাট। অপতিরোধ্য চারণ কবি।

গণনাট্য সঙ্ঘ সফলভাবে দুই বছর কার্য পরিচালনার পর ১৯৫৩ সালে জেলার প্রথম সম্মেলন আয়োজনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।এই সম্মেলনে কে হবেন প্রধান অতিথি?গুমানী তখন বাংলার ব্যস্ততম শিল্পী তাই সম্মেলনের সমস্ত দায়দায়িত্ব বর্তায় সুধীন সেনের কাঁধে।সুধীন সেন তার বন্ধু ‘নিরীক্ষা’ পত্রিকার সম্পাদক ও সাহিত্যিক রবীন মজুমদারের সাহায্যে যান সুচিত্রা মিত্র ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর কাছে।দুজনেই কাজের ব্যস্ততা দেখালে অবশেষে ঠিক হয় উৎপল দত্তের নাম।

উৎপল দত্তের পরিচিতি তখনও কলকাতার সীমানায় আবদ্ধ।এদিকে সম্মলনের দিন যতই এগিয়ে আসে ব্যস্ততা ততই বাড়ে।ঠিক হয় সম্মেলনের প্যান্ডেল বহরমপুর নতুন বাজারে করা হবে।নিজেদের কারো বাড়ি থেকে চৌকি,বাঁশ,কাপড় নিয়ে এসে নিজেরাই প্যান্ডেল,অডিটোরিয়াম তৈরি করেন।এই কাজে প্রায় চল্লিশজন মত শিল্পী সাহিত্যিক ছিলেন।এদিকে উৎপল দত্ত সাধারণ শ্রেনীর টিকিটে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে বহরমপুর এসে পৌঁছান।বর্তমান সময়ে যা দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না। উৎপল দত্ত আজীবন কমিউনিজমে বিশ্বাসী ছিলেন।যদিও তিনি কোন দলের সমর্থক ছিলেন না।তবে তিনি নিজেকে কমিউনিজমের প্রোপাগান্ডিস্ট বলে ভাবতেন।তাঁর বেশির ভাগ কাজে শ্রেণিসংগ্রামের চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যায়।টিনের তলোয়ার,কল্লোল,ব্যারিকেড,অঙ্গার দেখলে তা বোঝা যায়।সম্মেলনের সব কিছু ঠিক হওয়ার পর দুপুরে শুরু হয় প্রবল ঝড়বৃষ্টি তাতে ভেস্তে যায় সম্মেলনের সব আয়োজন।অপরাহ্নে বৃষ্টি কাফিনে শেষ পরেক ঠুকে অনুষ্ঠান দেয় পন্ড করে।সম্পাদক সুধীন সেন ও গুমানী দেওয়ান উৎপল দত্তকে অনুরোধ করেন যে একটি ঘরোয়া আলোচনাসভাতে আবৃত্তি গান করতে।উৎপল দত্ত সেই কথায় রাজি হয়ে যান।নাটক নিয়ে উৎপল দত্তের আলোচনায় মুগ্ধ শ্রোতৃমণ্ডলী বুঝতে পারে কেন তিনি বলিষ্ঠ অভিনেতা।সবশেষে উৎপল দত্তকে সুধীন সেন ও তাঁর দল গান শোনান। গান শুনে মুগ্ধ উৎপল দত্ত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।কারন সুধীন সেন গণসঙ্গীতকে দেশ রাগে সুর দিয়ে কিছুটা অংশ কীর্তন স্টাইলে গাইতেন।তখনকার দিনের এই অভিনব সংমিশ্রণ উৎপল দত্তের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল।উৎপলে মুর্শিদাবাদ আর মুর্শিদাবাদে উৎপলের মুগ্ধতায় সমাপ্ত হয় মুর্শিদাবাদ জেলা গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম সম্মেলন।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584